মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর লাগাতার নির্যাতনের ঘটনার পর সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাখাইন রাজ্যবিষয়ক একটি উপদেষ্টা কমিশন বা প্যানেল গঠন করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের কার্যত প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির অনুরোধে ওই উপদেষ্টা পরিষদকে নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনে কফি আনানসহ তিন বিদেশী এবং ৬ জন মিয়ানমারের নাগরিক রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চলে আসছে রাখাইন বৌদ্ধ এবং রাজ্যটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে। ২০১২ সালের সহিংসতায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় ক্যাম্পে চলে যেতে বাধ্য হন ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। সেখানে তাদের চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কর্তৃপক্ষ। নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ নৌপথে প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছে। অজ্ঞাতসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম নারী, শিশু ও পুুরুষ পালিয়ে যাওয়ার সময় সাগরে অনাহারে, নৌকা ডুবে বা দালালের অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা জোর দিয়ে বলে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। তারা রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বাঙালী’ বলে থাকে। রাষ্ট্রহীন-নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সরকারীভাবে ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের ধারাবাহিক নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সুচির মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন উঠে। আলোচনা সমালোচনা হয় যথেষ্ট। সুচির সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কয়েক মাস বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও গত জুন মাসে সুচি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে প্রথমবারের মতো ‘রাখাইন রাজ্যের মুসলিম’ হিসেবে অভিহিত করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এতে উগ্রবাদী বৌদ্ধরা বিক্ষোভ শুরু করে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ নামে অভিহিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। ওই সময় সুচি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আনানের ৯ সদস্যের কমিশন জাতিগত বিরোধের ক্ষত সারাবে। আমরা সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারি না। এড়িয়ে যাওয়া মানে খুব সহজেই সমস্যাকে আরও গুরুতর করে তোলা।’ উগ্রবাদীরা আনান কমিশনের সফরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও আনান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলাপ করেছেন। কফি আনান বলেছেন, তিনি আস্থাশীল যে আরাকানের জনগণের জন্য একটি অভিন্ন শান্তির পথ বের করতে তারা সক্ষম হবেন। সকল সচেতন মহলও এই দুই নোবেল জয়ীর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগের সাফল্য কামনা করেছেন।
লেখক কলামিস্ট কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় (মিয়ানমার) জাপানীদের কাছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আত্মসমর্পণ করেছিল। রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত সময়ে জাপানীদের দখলে ছিল। তখন বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি গঠন করা হয়। জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মির উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত করা। পরে জাপানীদেরও তাড়িয়ে বার্মাকে স্বাধীন করা। সেই সময়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস কয়েকবার অং সানের সঙ্গে রেঙ্গুন গিয়ে গোপন বৈঠকও করেছিলেন বলে কথিত আছে। দু’জনের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা হয়েছিল যে, একযোগে ব্রিটিশ শাসকদের তাড়িয়ে নিজ নিজ দেশকে স্বাধীন করার। তবে জেনারেল অং সান বার্মার স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। তিনি স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আততায়ীর হাতে নিহত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় জেনারেল অং সানের বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে কয়েকজন রোহিঙ্গা মুসলিম নেতাও তার সঙ্গে ছিলেন। জেনারেল অং সান কখনও রোহিঙ্গাবিদ্বেষী বা মুসলিমবিরোধী ছিলেন না। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বার্মায় অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেতারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কক্সবাজার জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আরও বলেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই প্রথম ইংরেজবিরোধী বৃহৎ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ পলিসিতে বার্মাকে শাসন করার অপকৌশল হিসেবে আরাকানের উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কু-মন্ত্রণা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে প্রধান শক্র হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল। যার পরিণতিতে কিছুদিন পরপর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধিয়ে রোহিঙ্গারা কখনও সেই দেশের নাগরিক নয় ঘোষণা করে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বার্মার স্বাধীনতার স্থপতি জেনারেল অং সানের রাজনৈতিক ও রক্তের উত্তরাধিকারী হলেন তার মেয়ে এনএলডি নেতা অং সান সুচি।
বিগত নির্বাচনে এনএলডিসহ ৩০টি দল অংশগ্রহণ করেছে। কোন দলই কোন মুসলমানকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়নি, যদিও প্রায় ত্রিশ লাখ মুসলিম মিয়ানমারে বসবাস করেন। আরাকান প্রদেশে তো কোন রোহিঙ্গা মুসলিমকে ভোটারও করেননি সেনা সমর্থিত সরকার। বার্মিজ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী করার কুমানসে বার্মার নাম বদলিয়ে রেখেছে মিয়ানমার। আরাকান রাজ্যের নাম রেখেছে রাখাইন। সেনাশাসক ও স্বৈরাচারী শাসকরা অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সব সময় ধর্মকে ব্যবহার করে। বার্মায়ও তা হয়েছে। বার্মায় জন্মগ্রহণকারী শত বছর ধরে সেই দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব, নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সেনা শাসকদের এই অবৈধ ও অমানবিক কাজ আরাকানের অনেক বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরাও পছন্দ করেন না। এটা মেনে নিতে পারেননি তারা।
বিগত নির্বাচনী ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের টমাস ফুলার একটি কৌতুহলোদ্দীপক মন্তব্য করেছেন। যে সেনাবাহিনী নতুন রাজধানী নেপিডো নির্মাণ করেছে, সেই নেপিডোই সেনাবাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারী কর্মকর্তা, সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অধ্যুষিত নেপিডো জেলায় আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে এনএলডি জয়ী হয়েছে। মিয়ানমারে সেনা শাসকদের দলকে পরাজিত করে অং সান সুচির দল বিজয়ী হয়েছে, গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। বার্মায় গণতন্ত্রের বিজয়ে কি মানবতা জয়ী হবে? আরাকান রাজ্য ব্যতীত অন্য রাজ্যে যেখানে মুসলমানরা ভোটার হয়েছে, সেখানে তারা বুকভরা আশা নিয়ে সুচির দলকেই ভোট দিয়েছে।