ওমর শাহ ::
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা আল বাকারা: ২৭৫) আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের রিজিকের ব্যবস্থাও করেছেন। এজন্য তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল ঘোষণা করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। সুদ ও মুনাফা দু’টি আলাদা বিষয়। যার একটি শরিয়তসম্মত আর অপরটি হারাম।
যে ঋণ ঋণদাতার জন্য কোনো ধরনের মুনাফা বয়ে আনে সেটাই রিবা বা সুদ। ইসলামে সব ধরনের সুদই হারাম। ইন্টারেস্ট, মুনাফা, লাভ, ফিন্যানশিয়াল চার্জ অথবা সুদ- যে নামেই তাকে ডাকা হোক- চাই তা মহাজনি সুদ হোক বা বাণিজ্যিক সুদ, চাই তা সরল সুদ, হোক বা চক্রবৃদ্ধি সুদ কিংবা ব্যাংকিং সুদ হোক। কম হোক বা বেশি হোক।
সুদের সংজ্ঞা
সুদের আরবি প্রতিশব্দ হলো- আর রিবা। আভিধানিক অর্থ- বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, প্রবৃদ্ধি, বিকাশ ইত্যাদি। বাংলা পরিভাষায় ব্যবহৃত সুদ শব্দটি মূলত ফার্সি ও উর্দু ভাষা থেকে আগত। ইংরেজিতে বলা হয়-Interest, profit, usary.
ইসলামি শরিয়তে রিবা বলতে বুঝায়, যা ঋণের শর্ত হিসেবে মেয়াদ শেষে ঋণগ্রহীতা মূল অর্থসহ অতিরিক্ত অর্থ ঋণদাতাকে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। নবী করিম (সা.) বলেন, যে ঋণ কোনো মুনাফা টানে তাই সুদ।
সুদ ও মুনাফার পার্থক্য
অনেকেই বলেন, সুদ ও মুনাফা একই জিনিস। কিন্তু আসলে তা নয়। সুদ ও মুনাফার পার্থক্যগুলো হলো-
এক. লেনদেনের ক্ষেত্রে ঋণের অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা সুদ। অপরদিকে ব্যবসায় মূলধন খাটানোর মাধ্যমে মূলধনের অতিরিক্ত আয় হলো- মুনাফা।
দুই. সুদের উপাদান সময়, সুদের হার ও ঋণের পরিমাণ। মুনাফা নির্ভর করে ব্যয় সাশ্রয় ও অনুকূল বাজার চাহিদার ওপর।
তিন. সুদের উৎপত্তি ঋণ থেকে। মুনাফার উৎপত্তি ব্যবসার মূলধন বিনিয়োগ থেকে।
চার. সুদে ঋণদাতা ঝুঁকি বহন করে না। কিন্তু মুনাফায় ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
পাঁচ. সুদের ফলাফল ঋণদাতা একা ভোগ করে। অপরদিকে মুনাফা যোগানদার ও ব্যবহারকারী উভয়ই ব্যবহার করে।
ছয়. সুদ পূর্ব নির্ধারিত। অপরদিকে মুনাফা অর্জিত হয় পরে।
সুদের প্রকারভেদ
ইসলামি অর্থনীতিতে সুদকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
১. রিবা আন নাসিয়াহ ও
২. রিবা আল ফজল।
রিবা আন নাসিয়া বা মেয়াদি সুদ
এটা হলো- প্রকৃত সুদ বা প্রাথমিক সুদ। কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে এ ধরনের সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রিবা আন নাসিয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে ঋণ পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদ দেওয়া থাকে এবং মূলধনের অতিরিক্ত প্রদানের শর্ত থাকে, সেটাই রিবা আন নাসিয়াহ।
রিবা আল ফজল
রিবা আল ফজল। এ প্রকারের সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। পণ্য সামগ্রী হাতে হাতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রিবা আল ফজলের উদ্ভব। এক জাতীয় পণ্যের কম পরিমাণের সঙ্গে বেশি পরিমাণ পণ্য হাতে হাতে বিনিময় করা হলে পণ্যটির অতিরিক্ত পরিমাণকে বলা হয় রিবা আল ফজল।
সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি হতে বর্ণিত, একদা হজরত বিলাল (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে হাজির হলো। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর পেলে? হজরত বিলাল (রা.) বললেন, আমাদের খেজুর নিকৃষ্টমানের ছিলো। আমি তা দু’সা এর বিনিময়ে এক ‘সা’ বারমি খেজুর বদলিয়ে নিয়েছি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ওহ! এতো নির্ভেজাল সুদ, এতো নির্ভেজাল সুদ, এতো নির্ভেজাল সুদ। কখনও এরূপ করো না। তোমরা যদি উত্তম খেজুর পেতে চাও নিজেরগুলো বাজারে বিক্রি করবে তারপর উন্নতমানের খেজুর কিনবে।
অনেক ইসলামি স্কলারের মতে, শুধুমাত্র হাদিসে বর্ণিত ৬টি পণ্যের ব্যাপারে রিবা আল ফজলের সীমা নির্ধারিত। কিন্তু অধিকাংশ ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হাদিসে উল্লেখিত পণ্য ব্যতিত অন্য যেকোনো পণ্য বদলের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা প্রযোজ্য। আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন, (সুরা আল বাকারা)
কোরআনুল কারিমে সুদ প্রসঙ্গ
ইসলামে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে অসংখ্য রেওয়ায়েত বিদ্যমান। কোরআনুল কারিমে সুদ সম্পর্কিত ১৫টি আয়াত রয়েছে। তন্মধ্যে ৭টি আয়াতে সরাসরি সুদকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সুদ সম্পর্কিত ১ম আয়াত নাজিল হয় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কি জীবনে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে।
হাদিসে সুদ প্রসঙ্গ
হাদিসে অনেকবার, নানা প্রসঙ্গে সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন নবী মুহাম্মদ (সা.)। ওই সব হাদিসে সুদের ভয়াবহতা উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লিখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয়- হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের ওপর লানত (অভিশাপ) করেছেন এবং তারা অপরাধের ক্ষেত্রে সবাই সমান। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, সুদ দ্বারা সম্পদ যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, তার শেষ পরিণতি নি:স্বতা।
পবিত্র কোরআনে বহু ধরনের গুনাহর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। সেসবের জন্য কঠোর শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে যত কঠোর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে অন্য কোনো গুনাহর ব্যাপারে এমনটি করা হয়নি।
সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের একটি সুদ : দুনিয়াতে যে সাতটি ধ্বংসাত্মক মহাপাপ আছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো সুদ। রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী? তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা; জাদু করা; অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন; সুদ খাওয়া; এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা; জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া; সতী মুমিন নারীদের অপবাদ দেওয়া।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৬৬)
সুদ সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত : সুদের সঙ্গে জড়িত সবাইকে নবীজি (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৬)
সুদের অর্থে কোনো বরকত নেই : সুদের মাধ্যমে যত অর্থই উপার্জন করুক, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাতে কোনো বরকত নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৬)
সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো—যেন মানুষের সম্পদের সঙ্গে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না।’
সুদখোর আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত : সুদখোর স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না করো (সুদের বকেয়া না ছাড়ো, সুদের কারবার অব্যাহত রাখো) তবে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও...।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৮-২৭৯)
সুদখোর ব্যভিচারকারীর সমতুল্য : ব্যভিচার সবার কাছে নিন্দনীয়। বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যভিচার আরো বেশি জঘন্য। আর স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে জড়িত। বর্ণিত আছে, ‘সুদ সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো—আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৫৩৪৫)
‘সুদ থেকে অর্জিত এক দিরহাম পরিমাণ অর্থ (প্রায় ৩০০ টাকা) ইসলামের দৃষ্টিতে ৩৬ বার ব্যভিচার করা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২১৯৫৭)
চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধের কারণ : সুরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করার কারণ হলো—কোরআন নাজিল হওয়ার সময় আরবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খাওয়ার প্রথা ছিল। তাই তা দূর করার জন্য স্বতন্ত্রভাবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। তার মানে এ নয় যে চক্রবৃদ্ধিহারে না হলে সুদ খাওয়া হালাল হয়ে যাবে। কারণ অন্যান্য আয়াতে তো যেকোনো রকমের সুদ খাওয়াকে হারাম করা হয়েছে।
ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত : যেকোনো ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো হালাল পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুলরা, তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো...।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৫১)
হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোনো ধরনের ইবাদত আল্লাহর নিকট গিয়ে পৌঁছে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৩০)
সুদখোরের পরকালীন জীবনের শাস্তি : সুদখোরকে মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বরজখি জীবনে আজাব দেওয়া হবে। তার আজাব হবে—তাকে এমন নদীতে সাঁতার কাটতে হবে, যার পানি হবে রক্তের মতো লাল এবং তাতে তার ওপর পাথর নিক্ষেপ করা হতে থাকবে। (বুখারি, হাদিস : ১৩৮৬)
সুদখোরের পেট সাপে পরিপূর্ণ : রাসূল (সা.) বলেছেন, মেরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের পেটগুলো বিশাল ঘরের মতো সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা ছিল অসংখ্য সাপে পরিপূর্ণ। যেগুলো পেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল, এরা কারা? তিনি জবাবে বলেন, এরা সুদখোরের দল। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৬৪০)
সুদখোর কিয়ামতের দিন যে অবস্থায় উঠবে : কিয়ামতের দিন সুদখোর পাগলের মতো উঠবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে। এটা এ জন্য যে তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই...।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুদের ভয়াবহতা বুঝে তা থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।