সূরা ইয়াসিন পবিত্র কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এই সূরার প্রথমে বর্ণিত দুই মুকাত্তায়াত হরফের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই সূরায় রয়েছে ৮৩টি আয়াত।
আজ এই সূরার ২৮ থেকে ৩৫ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ২৮ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى قَوْمِهِ مِنْ بَعْدِهِ مِنْ جُنْدٍ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا كُنَّا مُنْزِلِينَ (28) إِنْ كَانَتْ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ خَامِدُونَ (29) يَا حَسْرَةً عَلَى الْعِبَادِ مَا يَأْتِيهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ (30)
“এবং তারপর আমি তার সম্প্রদায়ের উপর আকাশ থেকে কোন বাহিনী অবতীর্ণ করিনি এবং (এর আগেও) আমি (বাহিনী) অবতরণকারী ছিলাম না। (অর্থাৎ আমার রীতি এর আগেও এরূপ ছিল না। )” (৩৬:২৮)
“বস্তুতঃ এ ছিল এক মহানাদ। অতঃপর হঠাৎ সবাই স্তদ্ধ হয়ে যায়। ” (৩৬:২৯)
“বান্দাদের জন্যে আক্ষেপ যে, তাদের কাছে এমন কোন রাসূলই (হেদায়েতের জন্য) আগমন করেননি যাকে তারা বিদ্রুপ করে নি। ” (৩৬:৩০)
গত আসরে আমরা বলেছি, শাম অঞ্চলের আনতাকিয়া শহরের জনগণকে হেদায়েতের জন্য কয়েকজন নবী আগমন করলে সেখানকার লোকজন তাদেরক লাঞ্ছনা করে এবং তাদের নবুওয়াত মেনে নিতে অস্বীকার করে। এ সময় নবীদেরকে রক্ষা করার জন্য হাবিবে নাজ্জার নামক এক ব্যক্তি এগিয়ে এলে কাফেররা তাকে হত্যা করে। এরপর এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, যে জাতি নবীদের অস্বীকার করে এবং এক ব্যক্তিকে শহীদ করে ফেলে তাদের ওপর ঐশী আজাব অবধারিত হয়ে যায়। আল্লাহর আদেশে এমন গগনবিদারী আওয়াজ হয়ে যার ফলে ওই জাতির সব লোক মৃত্যুবরণ করে। এই আজাব ছিল পার্থিব শাস্তি এবং কিয়ামতে তাদের জন্য আরো কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।
প্রকৃতপক্ষে কাফের ও গোনাহগার ব্যক্তিদের ধ্বংস করে ফেলা আল্লাহ তায়ালার জন্য অত্যন্ত সহজ কাজ। এই কাজের জন্য ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আসমান থেকে কোনো বাহিনী প্রেরণের প্রয়োজন নেই। বরং, আল্লাহর ইচ্ছায় আসমান ও জমিন থেকে এমন বিকট শব্দ হয় যে, এর ফলে সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পরের আয়াতে আল্লাহ তাঁর এ ধরনের বান্দাদের জন্য আক্ষেপ করে বলছেন, তারা আল্লাহর হেদায়েতের বাণী গ্রহণ না করে এমন আচরণ করে যা তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। নবী-রাসূলদের ঠাট্টা করা থেকে এই আচরণ শুরু হয় এবং তাদেরকে লাঞ্ছনা করে শেষ পর্যন্ত অনেক নবীকে মেরে ফেলা হয়।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. কোন সমাজ যদি আল্লাহর ওলীদেরকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করে বা তাদেরকে লাঞ্ছিত করে তাহলে সেই সমাজ আল্লাহর শাস্তিতে নিপতিত হতে পারে; যে শাস্তি আসে হঠাৎ করে।
২. দাম্ভিক ও অত্যাচারী ব্যক্তিদের হুমকিতে ভয় পাওয়া বা সত্য ত্যাগ করা যাবে না। আল্লাহ চাইলে অত্যাচারীরা অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
৩. অন্যরা সত্যকে বিদ্রূপ করলে আমাদের ঈমান যেন দুর্বল হয়ে না যায় এবং আমরা যেন ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে পিছ-পা না হই। সমস্ত নবী-রাসূল বিদ্রূপের শিকার হওয়া সত্ত্বেও সত্যের পথে অটল থেকেছেন।
সূরা ইয়াসিনের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنَ الْقُرُونِ أَنَّهُمْ إِلَيْهِمْ لَا يَرْجِعُونَ (31) وَإِنْ كُلٌّ لَمَّا جَمِيعٌ لَدَيْنَا مُحْضَرُونَ (32)
“তারা কি প্রত্যক্ষ করে না, তাদের পূর্বে আমি কত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি, যারা আর তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) কাছে ফিরে আসবে না?” (৩৬: ৩১)
“এবং ওদের সবাইকে (কিয়ামতের দিন) আমার কাছে উপস্থিত হতেই হবে। ” (৩৬:৩২)
আগের কয়েকটি আয়াতের সূত্র ধরে এই দুই আয়াতে সব মানুষকে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: তোমরা কেন অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস ও তাদের পরিণতি সম্পর্কে ভেবে দেখছ না? তোমরা কেন দেখছ না যে, তোমাদের পূর্বে কত শত জাতি এই পৃথিবীতে এসেছিল যাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে? তাদের মধ্যে অনেক জাতির ছিল সমৃদ্ধ সভ্যতা; ধনে-জ্ঞানে তাদের কোনো তুলনা ছিল না। কিন্তু আজ তাদের কোনো চিহ্ন এই পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। আজকের সমাজে ফিরে আসার কোনো ক্ষমতাও তাদের নেই।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. পবিত্র কুরআন বারবার অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস জানার ও তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু বিনোদনের জন্য ইতিহাস জানা যথেষ্ট নয়।
২. পৃথিবী পরিচালনায় আল্লাহর রীতি অভিন্ন এবং অতীত জাতিগুলোর পরিণতি প্রায় একই রকম। কাজেই যে জাতি মুক্তি পেতে চায় তার উচিত এসব জাতির পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের চলার পথ সংশোধন করা।
সূরা ইয়াসিনের ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَآَيَةٌ لَهُمُ الْأَرْضُ الْمَيْتَةُ أَحْيَيْنَاهَا وَأَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَأْكُلُونَ (33) وَجَعَلْنَا فِيهَا جَنَّاتٍ مِنْ نَخِيلٍ وَأَعْنَابٍ وَفَجَّرْنَا فِيهَا مِنَ الْعُيُونِ (34) لِيَأْكُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ وَمَا عَمِلَتْهُ أَيْدِيهِمْ أَفَلَا يَشْكُرُونَ (35)
“এবং তাদের জন্যে একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা থেকে ভক্ষণ করে। (৩৬:৩৩)
“এবং আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং তাতে প্রবাহিত করি ঝরনাধারা। ” (৩৬:৩৪)
“যাতে তারা তার ফল এবং নিজেদের হাতে উৎপাদিত শস্য খেতে পারে। সুতরাং তাদের কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত নয়?” (৩৬:৩৫)
এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: আখিরাতের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে মৃত ভূমির প্রাণ ফিরে পাওয়া। শীতকালে মাটি এমনভাবে শুকিয়ে যায় যাতে মনে হয় এখানে আর কোনোদিন শষ্য উৎপাদিত হবে না। কিন্তু গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মৃত ভূমি আবার সতেজ হয়ে ওঠে এবং তাতে নানারকম শস্য ও ফলমূল উৎপাদিত হয়। প্রতি বছর মানুষ তার চোখের সামনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখে।
আল্লাহর দেয়া খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পবিত্র কুরআনে খোরমা ও আঙ্গুরের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এই দুই ফলকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নেয়ামত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হয়ত এ কারণে একথা বলা হয়েছে যে, এই দুই ফলে যেমন মানুষের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্যগুণ রয়েছে তেমনি মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব ভিটামিনের সমাহার এই দুই ফলে ঘটেছে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. প্রকৃতি হচ্ছে আল্লাহকে উপলব্ধি করার কিতাব যার প্রতিটি পৃষ্ঠা অধ্যয়নের মাধ্যমে মানুষ তার স্রষ্টাকে আরো ভালোভাবে চিনতে ও বুঝতে পারে।
২. মানুষের পক্ষে পার্থিব জগতে বসে তার মৃত্যু পরবর্তী জীবন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আখিরাত দিবসের সত্যতা উপলব্ধি করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মাটি, গাছ ও গুল্মলতার জীবন ও মৃত্যু মানুষের সামনে বারবার দেখিয়ে দিয়েছেন।
৩. নানারকম খাদ্য ও ফলমূল ভক্ষণ করার কারণে মানুষের উচিত এসব খাদ্যের স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়