পবিত্র কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা আল-বাকারা আলোচনার আজকের পর্বে সূরাটির ১২৪ থেকে ১২৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। বনী ইসরাইলীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহপাক সূরা বাকারাহ’র ১২৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ (124)
“যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও (ইমাম) নিযুক্ত করুন। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না। ” (২:১২৪)
পয়গম্বরদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন বিশেষভাবে মর্যাদাবান। তাঁর নাম পবিত্র কোরআনের ২৫টি সূরায় ৬৯ বার এসেছে এবং তাকে মহানবী (সা.)-এর মতোই আদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই সূরাতেই এই আয়াত থেকে শুরু করে ১৮টি আয়াতে পবিত্র কাবাঘরের প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর এ নবীর কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইমামত লাভ করেন। এই আয়াতে ‘কালিমাত’ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ওপর অর্পিত কিছু কঠিন দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে যা কিনা তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল।
ওইসব কঠিন দায়িত্বের কয়েকটি দিক হচ্ছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার গোত্রের মধ্যে একমাত্র একত্ববাদী ছিলেন। কিন্তু তিনি একাই অসীম সাহসিকতার সাথে শিরক্ ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন। মূর্তিগুলো যেখানে রাখা হতো একদিন সেখানে ঢুকে তিনি সমস্ত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। মূর্তি ভাঙ্গার দায়ে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ় ঈমান ও স্থিরচিত্তে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সবাই লক্ষ্য করল আল্লাহর ইচ্ছায় আগুন ঠাণ্ডা হয়ে গেল এবং তার কোন ক্ষতিই হলো না।
হযরত ইব্রাহীমের জন্য আল্লাহর আরেকটি পরীক্ষা ছিল, তার পুত্র সন্তানকে কোরবানীর নির্দেশ। দীর্ঘদিন সন্তান থেকে বঞ্চিত থাকার পর আল্লাহ তাকে পুত্র সন্তান ইসমাইলকে দান করলেন। আল্লাহর নির্দেশে বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানকেই তিনি কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানী হয় এক পশু। এভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আল্লাহতালা তাঁকে ইমামতের মর্যাদা দান করলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে তার বংশধরদের জন্যেও ইমামতের মর্যাদাদানের প্রার্থনা করেন৷ আল্লাহপাক তার এই প্রার্থনার জবাবে বললেন, ইমামতের এই মর্যাদা বংশানুক্রমিক নয় বরং যার যোগ্যতা আছে সেই এ মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে।
রাসূলের দায়িত্ব হলো- আল্লাহর বাণী ও বিধি-বিধান পৌঁছে দেয়া এবং জনগণকে ভালো কাজের সুসংবাদ ও মন্দ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া। অপরপক্ষে ইমামের দায়িত্ব হলো সমাজে ওই বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
সূরা বাকারাহ’র এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, ইমামত আল্লাহর অঙ্গীকার ও আমানত, যা জালিম, অন্যায়কারী ও গুনাহগার ব্যক্তিরা পাবে না। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা জীবনে গুণাহ করেছে তারা ইমামতের দায়িত্ব পেতে পারে না।
এরপর ১২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ (125)
“(সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন কাবাঘরকে মানবজাতির সম্মিলন স্থল ও নিরাপদ কেন্দ্র করেছিলাম আর বলেছিলাম তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়াবার স্থানকেই নামাজের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর৷ আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাইলের সাথে অঙ্গীকার করেছি যে আমার ঘর তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী, রুকুকারী ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখবে। ” (২:১২৫)
এর আগের আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের সুউচ্চ মর্যাদা ও ইমামতের কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের মহান অবদান পবিত্র কাবাঘরের কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ঘর মানব ইতিহাসে একত্ববাদীদের মিলনস্থল। তাওয়াফ, নামাজ ও এবাদতের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ কেন্দ্র। হজ্ব যাত্রীরা মক্কা শরীফে গিয়ে কাবাঘর তাওয়াফের পর দু”রাকাত নামাজ পড়েন। তাদের এ নামাজ পড়তে হয় মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে। মাকামে ইব্রাহীম হলো কাবাঘর ঘেষা ওই পবিত্র স্থান যেখানে কাবাঘরের দেয়াল তৈরির সময় তিনি দাঁড়াতেন। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কষ্টের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে হাজীরা মাকামে ইব্রাহীমকে পেছনে রেখে নামাজ না পড়েন। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) শুধু কাবাঘরের নির্মাতাই ছিলেন না, তারা একইসাথে ওই পবিত্র ঘরের খাদেম বা সেবকও ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে তারা মসজিদুল হারামকে যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতেন যাতে আল্লাহর বান্দারা সেখানে নামাজ ও এবাদত করতে পারেন। মূলত: মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। আর এ ঘরের খাদেম বা সেবককেও হতে হবে পবিত্র এবং আল্লাহর অলী। যে কেউ মসজিদ দেখা শোনার মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অধিকারী হতে পারে না।
এরপর ১২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آَمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آَمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ قَالَ وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَى عَذَابِ النَّارِ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (126)
“স্মরণ কর যখন ইব্রাহীম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! একে নিরাপদ শহরে পরিণত কর আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ফলের দ্বারা রিযিক দাও৷ আল্লাহপাক ইব্রাহীমের প্রার্থনার জবাবে বললেন, কাফেরদেরকেও আমি কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগের সুযোগ দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো এবং তা কত নিকৃষ্ট পরিণাম!” (২:১২৬)
হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর প্রতিষ্ঠার পর সেটি এবাদতের জন্য প্রস্তুত করলেন এবং একইসঙ্গে মক্কাশরীফের অধিবাসীদের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’টি জিনিসের আবেদন জানালেন। একটি নিরাপত্তা ও শান্তি আর অপরটি হলো জীবন ধারণের জন্য রিজিকের ব্যবস্থা। যদিও ইব্রাহীম (আ.) কেবল মুমিনদের জন্য দোয়া করেছেন, কিন্তু তারপরও আল্লাহপাক জবাবে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবার জন্যে বস্তুগত রিজিক দান করবেন। তিনি কাফেরদেরকে তাদের অবিশ্বাসের জন্য দুনিয়ার ধন-সম্পদ বা ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করেন না। যদিও তারা তাদের কাজের জন্য পরকালে দোজখে প্রবেশ করবে।
এ আয়াতে দু’টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে-
প্রথমত: মুমিনদের জন্য দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও বস্তুগত কল্যাণের প্রয়োজন আছে এবং সেজন্যেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে তা চেয়েছেন ৷
দ্বিতীয়ত: কাফেররা পার্থিব ধন-সম্পদের অধিকারী হলেও তা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বা সৎ পথে থাকার প্রমাণ বহন করে না। বরং এ থেকে আল্লাহর কাছে পার্থিব সম্পদ যে মূল্যহীন তাই ফুটে উঠে।
এবারে সূরা বাকার’র ১২৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে –
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (127)
“যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল তখন তারা দোয়া করেছিলেন-হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। ” (২:১২৭)
হযরত আদম (আ.) এর সময় থেকেই কাবা ঘর ছিল ৷ কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) তা পুনঃনির্মাণ করেন। কারণ মক্কায় যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার স্ত্রী সন্তানকে বসবাসের জন্য নিয়ে গেলেন তখন বললেন, হে প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরকে এই শুষ্ক ও চাষবাসহীন এলাকায় তোমার ঘরের পাশে থাকার ব্যবস্থা করলাম৷ সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ইব্রাহীম (আ.) যখন মক্কায় আসেন তখন সেখানে আল্লাহর ঘর অর্থাৎ কাবাঘরের অস্তিত্ব ছিল৷ এছাড়াও সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে কাবাকে এবাদতের প্রথম ঘর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷
সূরা বাকারা’র ১২৭ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, যদি নিয়ত আল্লাহমুখী হয় তাহলে মিস্ত্রির কাজও এবাদত। মূলত: কাজ কি সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আল্লাহর দরবারে ওই কাজ কবুল হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যদি কাবা ঘরও নির্মাণ করি আর সে নির্মাণ কাজ যদি আল্লাহর দরবারে কবুল না হয় তাহলে তার কোন মূল্য নেই।
এই কয়েকটি আয়াতের মূল শিক্ষা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল –
১. আল্লাহপাক ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান করেন। দুনিয়ার নানা ঘটনা হলো আল্লাহর এক ধরনের পরীক্ষা, যাতে মানুষ সেসবের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে পারে এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পৌঁছুতে পারে।
২. ইমামত ও নেতৃত্ব খোদার দেয়া একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, এটি দুনিয়াবী কোন পদমর্যাদা নয়। সুতরাং ইসলামী সমাজের ওপর যে কেউ শাসন চালাতে পারে না এবং যেকারো নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার নেই ৷
৩. মসজিদ আল্লাহর ঘর এবং বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদার অধিকারী৷ তাই সৎ ও মুত্তাকী লোকদেরকে মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে ৷
৪. মক্কা হলো একটি আদর্শ ইসলামী শহরের দৃষ্টান্ত। এটি যেমন এবাদতের স্থান তেমনি নিরাপত্তার কেন্দ্র। মূলত: আল্লাহর এবাদত হতে হবে নিরাপত্তা ও শান্তির ছায়াতে। কারণ ধর্ম বৈষয়িক বিষয় থেকে আলাদা কিছু নয়।
পাঠকের মতামত