পবিত্র কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ সূরা আল-বাকারা আলোচনার আজকের পর্বে সূরা আল-বাকারা’র ২৫ থেকে ২৬ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৫ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন –
وَبَشِّرِ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هَذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (25
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নদী প্রবহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্তুতঃ তাদেরকে ইহকালের অনুরূপ ফল প্রদান করা হবে। এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। ” (২:২৫)
আগের আয়াতে কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখানোর পর এ আয়াতে মুমিনদের প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে। সৎ কাজ ছাড়া ঈমান ফলপ্রসূ হয় না। শুধু ঈমান বা শুধু ভালো কাজ কোনটিই এককভাবে মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে পারে না। ঈমান হচ্ছে গাছের মূল বা শিকড়ের মত আর ভালো কাজ হচ্ছে বৃক্ষের ফল স্বরূপ। গাছের সুমিষ্ট ও ভালো ফল, ওই গাছের সুস্থ ও সবল মূলের প্রমাণ দেয়। আর সবল ও সুস্থ মূলের গাছই ভালো ফল দিতে পারে। অবিশ্বাসী বা কাফেররাও অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঈমানের মজবুত ভিত না থাকায়, সে সব কাজ স্থায়ী হয় না। কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন মুমিন ব্যক্তিদের স্থান হবে বেহেশত। বেহেশতের বাগানগুলো চির সবুজ এবং ফলে-ফুলে ভরা। কেননা সজীবতার উৎস পানির নহর গাছগুলোর নীচ দিয়ে সবসময় বয়ে যাচ্ছে। বেহেশতের ফলগুলো দেখতে বাহ্যত: এ দুনিয়ার মতো যাতে বেহেশবাসীরা সেগুলো দেখেই চিনতে পারে। ফলগুলো যেন তাদের কাছে অদ্ভুত বা অপরিচিত মনে হয় না। তবে স্বাদ ও গন্ধের দিক থেকে সেগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।
বেহেশতে কেউ জন্ম গ্রহণ করে না। তবে মানুষ যেহেতু সঙ্গীবিহীন থাকতে পারে না তাই বেহেশতবাসীদের জন্য সেখানে সঙ্গিনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুত-পবিত্রতা তাদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যদিও পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে বস্তুগত অনেক নেয়ামত, যেমন বাগান, প্রাসাদ, সঙ্গিনী প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক আয়াতে এগুলোর সাথে বেহেশতে আধ্যাত্মিক নেয়ামতের কথাও বলা হয়েছে। যেমন সূরা তওবার ৭২ নম্বর আয়াতে বেহেশতের বস্তুগত বা বৈষয়িক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে – ‘‘আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ’’। পবিত্র কোরআনে বেহেশতী নেয়ামত ও ঐশ্বর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেহেশতবাসীদের স্থান ও আবাসস্থল সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘এটাই তাদের একমাত্র পুরস্কার নয়। ’ সেখানে পয়গম্বর, ওলি-আউলিয়া এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো ও সৎ ব্যক্তিদের মাঝে অবস্থানের ফলে সৎ ও ঈমানদারদের মনে আত্মিক প্রশান্তি আসবে এবং এটা তাদের জন্য স্বর্গীয় উপহার হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখানোর পাশাপাশি উৎসাহেরও প্রয়োজন আছে। কাফেরদেরকে জাহান্নামের ভয় দেখানোর পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
২. ঈমানের বাহ্যিক রূপ হচ্ছে ভালো কাজ। এজন্য পবিত্র কোরআনে এ দু’টি অর্থাৎ ঈমান ও সৎ কাজ সব সময় এক সাথে এসেছে।
৩. পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে ভালো কাজ সেটাই যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হবে।
৪. দুনিয়ার ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি ক্ষণিকের জন্যে এবং তা অস্থায়ী। কাজেই মানুষ তা হাতছাড়া করলে দুঃখ পায় এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু আখেরাত বা পরকালের ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি চিরন্তন ও তা সব সময় স্থায়ী থাকবে। কাজেই তা হারাবার ভয় থাকবে না। আর এ জন্যেই এই আয়াতে বলা হয়েছে ‘বেহেশতবাসীরা সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করবে। ‘
এরপর ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَحْيِي أَنْ يَضْرِبَ مَثَلًا مَا بَعُوضَةً فَمَا فَوْقَهَا فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَذَا مَثَلًا يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلَّا الْفَاسِقِينَ (26
নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ মশা কিংবা তারচেয়ে বড় উপমা দিতে সংকোচ বোধ করেন না। সুতরাং যারা বিশ্বাসী তারা জানে যে, এ সত্য উপমা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে এবং যারা অবিশ্বাস করে তারা বলে এই উপমাতে আল্লাহর অভিপ্রায় কি? এর দ্বারা তিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে সৎ পথে পরিচালিত করেন। কিন্তু অসৎ লোক ছাড়া তিনি কাউকে বিভ্রান্ত করেন না। ” (২:২৬)
ইসলামের বিরুদ্ধবাদী কাফেররা যখন পবিত্র কোরআনের অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনা করতে ব্যর্থ হলো, তখন তারা কোরআনের উপমাগুলোকে বাহানা হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল। তারা বললো, এ সব উপমা থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার স্থান অনেক উর্ধ্বে। সৃষ্টিকর্তা মশা, মাছি ও মাকড়সার মত তুচ্ছ উপমা দিতে পারেন না, এসব মানুষেরই কাজ। আসলে ইসলামে অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তাকেই বিশ্বাস করতো না। এ সব কথা বলার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোরআন ও পয়গম্বরের ওপর মুসলমানদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দেয়া এবং তাদের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়া। তা ছাড়া পবিত্র কোরআনের সব উপমাই এ ধরনের নয়। যেমন এর আগে মুনাফিক বা কপট ব্যক্তিদেরকে অন্ধকারে আলোহীন বিপদ সংকুল পথে আটকে পড়া পথিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর উদাহরণ বা উপমা ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে- বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে তোলা। যখন কেউ দুর্বল প্রতিপক্ষের বর্ণনা দিতে চায়, তখন কোন দুর্বল বস্তু বা প্রাণীর উপমা দিয়ে তার বর্ণনা তুলে ধরে। যেমন পবিত্র কোরআনের সূরা হজ্জ্বের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা কর তারা তো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এমনকি এ উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও। এবং মাছি যদি কিছু নিয়ে চলে যায় তাও তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। ”
সূরা বাকারা’র ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “আল্লাহপাক মাছি বা তারচেয়ে ছোট প্রাণীকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন না। কেননা উপমা তো কেবল বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে বোঝাবার জন্য। মানুষ যে কথা বা উদাহরণে ভালো বুঝবে সেটিই উপমা হিসাবে ব্যবহার করা উচিৎ। উপমা বা উদাহরণের ক্ষেত্রে মশা বা বিশাল হাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য পবিত্র কোরআনের উপমাগুলো সম্পর্কে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন মানুষ দেখা যায়। এর মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী এবং কোরআনের উপমাগুলোর নিগূঢ় তত্ত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম তারা এ সব উপমা থেকে সত্যের সন্ধান লাভ করেন এবং বস্তুজগতের নিগূঢ় তত্ত্ব তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। অপর দিকে যাদের অন্তর পবিত্র কোরআন ও ইসলামের মহান নবীর প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পূর্ণ তারা পবিত্র কোরআনের অর্থ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং কোরআন ও পয়গম্বরের ব্যাপারে দোদুল্যমনার কারণে ঐশী পথ নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
এ আয়াত দু’টি থেকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-কোন গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয় সব সময় সহজ ভাষায় বর্ণনা করা উচিৎ যাতে সাধারণ মানুষও ভালো করে বুঝতে পারে। পবিত্র কোরআনে অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য কখনো কোন প্রাণীকে, আবার কখনো প্রকৃতির কোন ঘটনা যেমন বৃষ্টি ও বজ্রপাতকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গুনাহ বা পাপ মানুষকে সত্য উপলদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং বিভ্রান্তি ও বিপথগামীতায় নিমজ্জিত করে। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে সবই সত্য ও বাস্তব। সৎ পথ প্রাপ্তি বা বিপথগামীতা ওই মহা সত্যের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ফল
পাঠকের মতামত