কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ–প্রতিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগের মধ্যে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রবাল দ্বীপের অস্তিত্ব নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূল ছুঁয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বাংলাদেশের উপর দিয়ে না গেলেও এবং ভাটার সময় ঝড় আঘাত হানায় জলোচ্ছ্বাস তেমন না হলেও প্রবালদ্বীপটির পশ্চিম পাড়া, পূর্ব পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, উত্তর পাড়া, নজরুল পাড়া, মাঝের পাড়া, ডেইল পাড়া, কোনার পাড়া ও গলাচিপা পাড়ায় সাগরতীরের কয়েক ফুট অংশ ভেঙে সাগরে মিশে গেছে।
ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে সেন্ট মার্টিনের কয়েকটি এলাকা ক্ষয়ের ঝুঁকিতে থাকলেও এ ধরনের ক্ষয়কে কেবল ‘মোখা’র প্রভাব বলতে নারাজ একজন বিশেষজ্ঞ। সাময়িকভাবে দ্বীপের স্থলভাগের কী পরিমাণ ক্ষয় হয়েছে বা সাগরে মিশে গেছে তা চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এবং এনভায়রনমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের প্রধান আবু শরীফ মো. মাহবুব–ই–কিবরিয়া জানান, দ্বীপের উত্তর পাড়া, মাঝের পাড়া ও গলাচিপা পাড়া ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ঢেউয়ের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাড়ার জেটি এলাকার কিছু অংশ ভাঙতে ভাঙতে হোটেল স্থাপনার কাছাকাছি চলে এসেছে। সেন্ট মার্টিনের উত্তর দিকে উপকূলের কিছু অংশ ১০ থেকে ১৫ ফুট ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সাগরে মিশে গেছে। এছাড়া গলাচিপার কিছু অংশও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে পুরো দ্বীপের উপকূলে যেসব অংশে সেডিমেন্টেশন বেশি, সেগুলো অল্প করে হলেও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখায় সেন্ট মার্টিনের অনেক গাছপালা ও বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস বেশি না হওয়ায় খুব বেশি ভাঙেনি। তিনি জানান, দ্বীপের কতটুকু অংশ বিলীন হয়েছে তা নির্ধারণের পরিকল্পনা করেছে ইনস্টিটিউটের একটি দল। দ্বীপের ‘সয়েল প্রোফাইলিংয়ের’ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবু শরীফ জানান, স্বল্প গভীরে (গড়ে ৩–৫ মিটারের মধ্যে) পাথর পাওয়া যাওয়ায় এ ‘রক আইল্যান্ডের’ সাগরে একেবারে বিলীন হওয়ার বা ডুবে যাওয়ার কোনো শঙ্কা নেই।
ঘূর্ণিঝড় মোখার আগে–পরে সেন্ট মার্টিনের সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করেছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান। ঘূর্ণঝড়ের প্রভাবে দ্বীপের বালুকাময় কিছু এলাকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সাগরে ‘বিলীন’ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ক্ষয়ে যাওয়া অংশ সাগরপাড়ের ভরাট বালিময় এলাকা। কী পরিমাণ ক্ষয়ে গেছে তা পরিমাপ ছাড়া বলা যাবে না। তবে উত্তর–পূর্ব অংশের ৫ ফুটের মতো হতে পারে। এটা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। সহসা একটা সংবাদ পাবেন। সেখানে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হবে বলে জানান কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, আমরা দ্বীপের একটি অংশে গিয়েছিলাম। দেখলাম কিছু অংশে ক্ষয় (ইরোসন) দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীও ছিলেন, উনিও দেখেছেন। এখানে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে পরিবেশগত কিছু বিষয় রয়েছে, উনারা এটা নিয়ে একটা বড় পরিসরে সমীক্ষা করতে চাইছেন। এতে জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি এ ধরনের ঝুঁকি কিভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে কর্মপরিকল্পনা থাকবে।
তবে দ্বীপের সাবেক একজন জনপ্রতিনিধি বলছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে দ্বীপের ভূমির তেমন ক্ষয় হয়নি। সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ তার দীর্ঘ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, দ্বীপের কিছু জমি ও উত্তর–মাঝের পাড়ার কিছু অংশ অমাবস্যা–পূর্ণিমায় সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে ঢেউয়ের সময় ভেঙে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় ১৫ থেকে ২০ ফুট বা উত্তর দিকে ও উত্তর পশ্চিমাংশে দ্বীপের মূল অংশ ভাঙছে। তবে মোখার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় তেমন ভাঙেনি। গত ১৫ বছরে মিনিমাম দেড়শ একর জমি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। উত্তর দিকেও ভাঙছে, পশ্চিম দিকেও ভাঙছে।
একই ধরনের মত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউভিার্সিটির ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড হাইড্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব আলম খান। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সেন্ট মার্টিনের ‘লাইন ইরোশন’ হয়নি। ভূতাত্তিক গঠন ও অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর ও মাঝের অংশে ক্ষয় হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার সময়ে বিশেষ কারণে দ্বীপের একটি অংশ ভাঙছে, তা নয়। তার ভাষ্য, ঘূর্ণিঝড়টি সেন্ট মার্টিনের উপর দিয়ে যায়নি, এর প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসও হয়নি, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ যেভাবে অতিক্রম করেছে তাতে দ্বীপের কোথাও ভেঙে যাওয়ার মতো প্রভাব পড়েনি।
গত পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেন্ট মার্টিনে আসা–যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, দ্বীপের উত্তরে এক ধরনের লং শোর কারেন্ট বিদ্যমান, মানে এখানে ঢেউয়ের একটা প্রভাব রয়েছে। সমুদ্রতীর অভিমুখী এসব জোয়ারের প্রভাব অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় থাকে। ওশানাগ্রোফির কিছু এ ধরনের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এ জন্যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয় হয়ে থাকে। এটাকে মোখার প্রভাব বলা ঠিক হবে না। দ্বীপের উত্তরে মহীসোপানের শেষ প্রান্তে সাগরের অভ্যন্তরে এক ধরনের ওয়াল রয়েছে। এখানকার বিশেষত্বের কারণে মোখার ঘূর্ণিবায়ু থাকলেও জোয়ার না থাকায় জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবও তেমন পড়েনি। তবে দ্বীপের পরিবেশ ও প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জানিয়ে এ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ও যথাযথ কার্যক্রম বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর–পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবালদ্বীপ। এটি কঙবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। সর্বতোভাবে দ্বীপটি সমতল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩.৬ মিটার উপরে। এখানে পশ্চিম–উত্তর পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে ১০–১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। দ্বীপটি ৭.৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং উত্তর–উত্তরপশ্চিম এবং দক্ষিণ–দক্ষিণপূর্ব দিক জুড়ে বিন্যস্ত। ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত।
মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে কয়েকটি বিশিষ্ট ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া নামে অভিহিত করা হয়, যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। উত্তর পাড়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে একটি অগভীর উপহ্রদ রয়েছে এবং জোয়ারের সময় পশ্চিম তীরের একটি সংকীর্ণ নদীখাতের মাধ্যমে এটির সাথে সমুদ্রের সংযোগ ঘটে।
প্রশাসনিকভাবে সেন্ট মার্টিন কঙবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। সেখানে গ্রাম আছে সব মিলে নয়টি। স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় দশ হাজার। এ দ্বীপ সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র। এছাড়া এখানে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল এককালে। এসব প্রজাতির অনেকগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেছে সরকার