জসিম মাহমুদ, টেকনাফ::
সেন্ট মার্টিনে ঘুরতে যাওয়ার নতুন মৌসুম জমে উঠতে আরও কিছুটা বাকি; পর্যটকের আনাগোনা কম থাকায় অনেকটাই সুনসান দ্বীপের এদিক সেদিকে এখন দেখা মিলেছে ভিন্ন দৃশ্যের। আরও বেশি পর্যটকের থাকার আয়োজনের জন্য চলছে নির্মাণ কাজের তোড়জোড়; নিয়ম না মেনেই যেগুলো করা হচ্ছে বলে উঠেছে অভিযোগ।
কিছুটা কম কোলাহলের এসময়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে বেশ কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট ও ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে প্রায় সবখানেই। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই সেখানে নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ এসব স্থাপনার চারদিক টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে কাজ করছেন, যাতে লোকজন সেখানে ঢুকতে না পারে।
বঙ্গোপসাগরের মধ্যেকার নয়নাভিরাম এ দ্বীপ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ছোট্ট এ দ্বীপের গলাচিপা এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে বেশি। পাশাপাশি ডেইল পাড়া, দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া ও উত্তর সি বিচ এলাকায় নতুন ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি পুরনো রিসোর্ট বা হোটেল চত্বরে নতুন ভবন নির্মাণের কাজও চলছে। কোনটিতে আবার নতুন ঘর বানানো হচ্ছে।
নির্মাণ নিয়ে যত অভিযোগ,
ইট-পাথর দিয়ে নতুন এসব স্থাপনা ‘অবৈধভাবেই’ গড়ে তোলা হচ্ছে বলে অনেকেরই অভিযোগ। আগে থেকেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনার সংখ্যা প্রায় ২০০টি বলে সেখানকার পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য।
অথচ আইন অনুযায়ী, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুরনোগুলো উচ্ছেদ করার কথা; কিন্তু সেটা তো দূরের কথা, প্রতিদিন সেখানে বাড়ছে অবৈধ স্থাপনা। ইট-কাঠের জঞ্জালে প্রতিদিন নষ্টের হুমকিতে পড়ছে দেশের একমাত্র এ প্রবাল দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ।
এসব বিষয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবস্থানরত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বলেন, “গত বছর (২০২২) পর্যন্ত দ্বীপে অবৈধভাবে নির্মিত রিসোর্টের সংখ্যা ছিল ১৯২টি। এরপর আরও নতুন করে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে।
“আমরা সেগুলোর তালিকা করছি। নতুন ১৪টি পাকা ও আধাপাকা রিসোর্ট মালিককে নোটিস দিয়ে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।”
এরই মধ্যে অনেক স্থাপনার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
গত রোববার জেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সভাতেও সেন্ট মার্টিনের অবৈধ স্থাপনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখন এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ দ্রুত অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, “জেলা প্রশাসনের সভায় সেন্ট মার্টিনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকাও হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও পরিবশে অধিদপ্তর দ্রুতই অভিযানে নামবে।”
উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বিভিন্ন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ মূলত পর্যটন মৌসুম বন্ধের সময়কালে তাদের স্থাপনাগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু করে। যাতে কারও নজরে না আসে। একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত অর্ধশতাধিক স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।
তারা বলছেন, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে নির্মাণ সামগ্রী নেওয়া নিষিদ্ধ। সরকারি কাজের জন্য নিতে হলেও উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। তবে কিছু অসাধু ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাতের আঁধারে এসব নির্মাণ সামগ্রী দ্বীপে নিয়ে যায় নিয়মিত।
কয়েকজন এমন অভিযোগও করেন, সরকারি কাজের কথা বলেও অনেক সময় এগুলো পরিবহন করে নিয়ে গিয়ে রিসোর্ট নির্মাণকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়। প্রশাসন এসব স্থাপনা উচ্ছেদের কথা বললেও ‘অজ্ঞাত কারণে’ তা আর হয় না।
বন্ধের সময়কে বেছে নেন নির্মাণ কারীরা,
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের অদূরে সাগরের বুকে ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।
এ দ্বীপ সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র। এখানে এককালে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল।
কালের ধারায় এসব প্রজাতির অনেকগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনের ৫৯০ হেক্টর এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করেছিল সরকার।
এ অবস্থার মধ্যেই একমাত্র এ প্রবাল দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছরই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। পর্যটক টানতে রিসোর্টগুলোও আধুনিক ইট-কাঠের ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করছে। ফলে পরিবেশ প্রতিদিন হুমকির মধ্যে পড়ছে।
প্রতিবছর সাধারণত অক্টোবরের শুরু থেকে এ নৌ-পথে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। পর্যটকরা এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত ভ্রমণে যেতে পারেন। পরে বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠলে নিরাপত্তা বিবেচনায় এ পথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ বন্ধের সময়টুকুতে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়ে বলে জানান স্থানীয়রা।
নির্মাণ কোথায় কোথায়,
সম্প্রতি সরজমিনে গিয়ে ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপের বেশ কিছু জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। কিন্তু এর ধারে কাছে ভেড়ার কোনো উপায় নেই। কড়া নিরাপত্তা। অনেক ক্ষেত্রে কাজের জায়গায় শুধু শ্রমিকদের দেখা যায়, যারা এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চান না।
কয়েকজন শ্রমিক জানালেন, তারা মালিকের কাজ করছেন। দিনমজুরি নিচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। মালিক কে, সেটিও জানেন না কিংবা বলতে চান না।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দ্বীপের জেটির দক্ষিণ পাশে বোটে নামে ইট, বালু, সিমেন্ট, কংকিটসহ স্থাপনা তৈরির মালামাল। পরে সেগুলো নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাই দেখলে-জানলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ড ‘লুইপাস ইকো রিসোর্টে’ বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানকার ভবনগুলো রক্ষার জন্য সমুদ্র সৈকতে ইট, সিমেন্ট, লোহা আর বালু দিয়ে রক্ষাবাঁধ তৈরি করা হয়েছে।
কিছুটা দূরের কোনা পাড়ায় ‘সমুদ্র কুটির রিসোর্টের’ পাশে একটি ভিআইপি কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে। এক বাউন্ডারিতে সাতটি কটেজ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। রিসোর্টটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন মো. আবছার নামে এক যুবক। তিনি জানান, রিসোর্টটির মালিক ঢাকার এক ব্যবসায়ী, কিন্তু নাম বলতে রাজি না তিনি।
সেন্টমাটিনের ডেইল পাড়ার উত্তর সীবিচে ‘হোটেল রয়েল বিচে’ তৃতীয় তলার কাজ চলছে। কয়েকবার চেষ্টা করেও এটির কারও সঙ্গে কথা বলা যায়নি। পরে তাদের ফেইসবুক পেইজ থেকে বুধবার সকালে যোগাযোগের নম্বর নিয়ে কল করা হলে একজন সেটি ধরেন। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন দিলেও কেউ সাড়া দেয়নি।
এটির পাশে ‘ট্রপিকানা বিচ রিসোর্টের’ বাউন্ডারি ও কয়েকটি ভবনের কাজ চলছে। এছাড়া পশ্চিম কোনাপাড়ায় ‘সূর্যস্নান টুইন বিচ রিসোর্ট’ এবং একটু সামনে প্রায় ছোট-বড় আটটি রিসোর্ট নির্মাণের কাজ চলছে। গলাচিপার পশ্চিম সৈকতে পাঁচটি ভবন তৈরির কাজ চলতে দেখা গেছে।
নির্মাণ কাজ চলা ভবনগুলোতে উপস্থিত ব্যক্তিরা কোনো কথা বলতে চাননি।
ফেইসবুক পেইজ থেকে নম্বর নিয়ে কথা বলা হয় ‘সূর্যস্নান টুইন বিচ রিসোর্ট’ এর এক ব্যক্তির সঙ্গে। তার নাম কিরণ। তিনি রুম বুকিং দিয়ে থাকেন বলে জানালেন।
সেখানে নতুন করে চারটি কক্ষ তৈরির কথা জানতে চাইলে কিরণ বলেন, তিনি এ নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পরে ইট-সিমেন্ট-কংক্রিট দিয়ে স্থাপনা তৈরি নিষিদ্ধ, তারপরও কেন কক্ষ নির্মাণ করা হচ্ছে- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কোথায় নিষিদ্ধ? আপনার কাছে কোনো ডকুমেন্ট আছে?”
একপর্যায়ে কিরণ বলেন, “গোটা সেন্ট মার্টিনে এমন কোনো রিসোর্ট আছে যেখানে ইট-সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক জায়গায় তো টাইলসও ব্যবহার হচ্ছে।”
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, “সেন্ট মার্টিনে নতুন করে আবারও অনেক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন চাইলে করতে পারত না।”
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, “স্থাপনা হচ্ছে সত্য। আমরা তাদের নিষেধ করছি এটাও সত্য। কিন্তু আমি খুব ছোট মানুষ। বড় বড় মানুষরা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে, বুঝেনই তো।
নিষিদ্ধ থাকার পরও মালামাল কীভাবে আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ধরেন, এখানে কিন্তু অনেক সরকারি কাজ চলে। যেমন লাইট হাউজ হচ্ছে, পোস্ট অফিস হচ্ছে, সরকারি বিভিন্ন অফিস হচ্ছে। তাদের মালামাল আসছে। আমরা শুনি যে, এর ফাঁকে ফাঁকে নাকি অসাধু ব্যক্তিরাও নিজেদের মালামাল নিয়ে আসছে।”
ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, “আমি একাধিকবার জেলা প্রশাসনকে বলেছি, সেন্ট মার্টিনের পরিবেশের ভারসাম্য যদি বজায় রাখতে চান, তাহলে এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থায়ী লোক দিতে হবে, অভিযান চালাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিতে হবে। যারা অবৈধভাবে স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নেবে সঙ্গে সঙ্গে সেটি বন্ধ করে দেবে।”
এ ব্যাপারে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, “টেকনাফে যেকোনো নির্মাণ সামগ্রী নিতে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি লাগে। কিন্তু একটি অসাধু গোষ্ঠী রাতের আঁধারে বোটে করে অনেক সময় মালামাল নিয়ে যায়। সাগর উত্তালের সময় টেকনাফে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে। তখন হয়তো এটা করা হয়।
“যারা সেন্ট মার্টিনে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করছে এরই মধ্যে আমরা উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছি।
ইউএনও বলেন, “আমরা আশা করছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আগামী সপ্তাহের শুরুতেই এসব স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করব।”
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে এখন অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ। আর পর্যটকদের স্থান দিতে গিয়ে যত্রতত্র হোটেল-মোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
“হোটেল-মোটেল নির্মাণের জন্য ইট, বালু, সিমেন্ট, কংক্রিটসহ বিভিন্ন মালামাল কীভাবে যাচ্ছে, কারা নিয়ে যাচ্ছে, তা তদন্ত কমিটি গঠন করে খতিয়ে দেখা দরকার।”
সেন্ট মার্টিনকে রক্ষার জন্য যে ১৩টি নীতিমালা রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা না হলে এই প্রবাল দ্বীপকে ভবিষ্যতে রক্ষা করা যাবে না বলে অভিমত এই পরিবেশকর্মীর।