আবদুর রাজ্জাক,মহেশখালী:
কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে সমুদ্র থেকে ডাকতি করে আনা মালামাল ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুই জলদস্যু বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধ,বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় উভয় পক্ষের ৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। বুধবার সকাল দশ টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব পাড়ায় জলদস্যু সম্রাট নাগু মেম্বার বাহিনী ও তার ভাজিতা আরেক জলদস্যু জাম্বু /বতইল্যা বাহিনীর মধ্যে এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি ঘটে। এসময় দুই জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা অন্তত ১৪/১৫ টি বাড়িঘর ভাংচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। খবর পেয়ে মহেশখালী থানার একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। লোকালয়ে প্রকাশ্যে গুলির্বষণের ঘটনায় এলাকাবাসির মধ্যে চরম আতংক বিরাজ করছে এবং অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এই ঘটনায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ঘটনার বিবরণ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়,গভীর সমুদ্র থেকে বিভিন্ন ফিশিং ট্রলার ও জাহাজ থেকে ডাকতি করে আনা মালামাল ভাগাবাটোয়ারা নিয়ে বুধবার সকাল দশ ঘটিকার সময় উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপের পূর্ব পাড়ায় জলদস্যু সম্রাট নাগু মেম্বার বাহিনী ও তার ভাজিতা আরেক জলদস্যু জাম্বু ও সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধ আরম্ভ হয়। এসময় উভয় পক্ষ প্রায় ৩/৪ শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে এবং র্দীঘ চার ঘন্টা পর্যন্ত এই বন্দুকযুদ্ধ স্থায়ী হয় বলে জানান এলাকাবাসিরা। এতে উভয় পক্ষের ৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছে । আহতরা বিভিন্ন মামলার পলালক আসামী হওয়ায় গোপনে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এসময় দুই জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা অন্তত ১৪/১৫ টি বাড়িঘর ভাংচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। ঘটনার সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এব্যাপারে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র বণিক জানান, সোনাদিয়া দ্বীপে দুই জলদস্যু বাহিনীর মধ্যে গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া মাত্র মহেশখালী থানার একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে জলদস্যুদের ধাওয়া করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সোনাদিয়া দ্বীপে সরাসরি গাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তড়িৎ গতিতে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন ও জলদস্যুদের গ্রেফতারের করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অচিরেই এসব জলদস্যুদের গ্রেফতারের করা হবে বলে তিনি এই প্রতিনিধিকে জানান।
জলদস্যু স¤্রাট নাগু/নকিব/ জাম্বু ও বতইল্যার ইতিকথা:=
বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জলদস্যু গড়ফাদার নাগু ও তার ছেলে নকিব বাহিনী এবং তার ভাতিজা জলদস্যু সর্দার মোশারফ জাম্বু ও সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা বাহিনী মধ্যে দ্বন্ধ চলে আসছে। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে এই বিভাজনের সূত্রপাত হয়। এই দ্বন্ধ নিয়ে দু’টি পক্ষে ভাগ হয়ে যায় নাগু ও জাম্বু-সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা। এর সূত্র ধরে বিগত এক বছর আগে দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। দীর্ঘ সময় সবাই এক সাথে একত্রিত হয়ে গভীর বঙ্গোপসাগরসহ সোনাদিয়া সমুদ্র চ্যানেলে, বিভিন্ন ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি ও সাগরে জলদস্যুতা চালালেও বর্তমানে দ্বন্ধের কারণে দু’ভাগে ভাগ হয়ে ডাকাতি চালাচ্ছে তারা। এক বাহিনীর নেতৃর্ত্বে রয়েছেন আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বারের ছেলে নকিব এবং অপর বাহিনীর নেতৃর্ত্বে রয়েছেন তখনকার সময়ে সোনাদিয়া দ্বীপের জলদস্যু স¤্রাট নাগুবাহিনীর সেকেন্ড ইন কামান্ড জাম্বু। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপে পড়ে যাওয়ায় আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার বাহিনীর হাল ধরে তার পুত্র নকিব। নকিব তার নতুন বাহিনীর নামকরণ করেন ‘বিচ্ছু বাহিনী’। বর্তমানে এই বাহিনী ‘বিচ্ছু বাহিনী’ নামে পরিচিত। মুলত সোনাদিয়া দ্বীপের অঘোষিত জলদস্যু স¤্রাট আবদুল গফুর প্রকাশ নাগু মেম্বার বাহিনীর সব কিছুই এখন নিয়ন্ত্রণ করেন ‘বিচ্ছু বাহিনী’। এই ‘বিচ্ছু বাহিনী’র প্রধান তারই ছেলে নকিব। অপরদিকে তখনকার সময়ে সোনাদিয়া দ্বীপের জলদস্যু স¤্রাট নাগুবাহিনীর সেকেন্ড ইন কামান্ড জাম্বু জেলা পুলিশের সাথে এক বন্দুক যুদ্ধে একটি পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় তার বাহিনীর হাল ধরেন তারই শিষ্য সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা । বর্তমানে জাম্বু বাহিনীর সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা অর্থাৎ “বতইল্যা বাহিনী”।
এলাবাসি সূত্রে জানা যায়, জলদস্যুদের অভয়ারণ্য খ্যাত বিছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়ায় নাগু মেম্বার/ নকিবের ‘বিচ্ছু বাহিনী” ও জলদস্যু জাম্বু/সরওয়ার প্রকাশ বতইল্যা বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে বিগত ১৫ দিন আগে থেকে। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করাই ছিল দুই জলদস্যু বাহিনীর মুল লক্ষ্য। কারণ এলাকায় যার আধিপত্য বিস্তার চলবে সেই গভীর বঙ্গোপসাগরসহ সোনাদিয়া সমুদ্র চ্যানেলে জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণ করবে। এই জন্য এই দুই জলদস্যু বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র,গোলাবারুদসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এক প্রকার রণপ্রস্তুতির নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে অবস্থান নেয়। ১৫ দিনের রণপ্রস্তুতির পর আজ বুধবার সকালে প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দুই জলদস্যু বাহিনী। দুই জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা এলাকার নিরহ অসহায় লোকের প্রায় ১৪/১৫ টি বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালায় ও ভাংচুর করে।
জানা যায়,সম্প্রতি গভীর বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের উৎপাত আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ভরা মৌসুমেও উপকুলীয় এলাকার হাজার হাজার জেলেরা জলদস্যুদের ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেনা। ফলে জেলে পল্লীতে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয় ও কালো মেঘের ছায়া। জলদস্যুদের ভয়ে জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে না যাওযায় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবণ যাপন করছে। গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফিরে আসার পথে সোনাদিয়া সমুদ্র চ্যানেলে গত এক সপ্তাহ আগে ৫ টি ফিশিং ট্রলার জলদস্যুর শিকার হয়েছ্।ে জলদস্যুরা মাঝি-মাল্লাদের ব্যাপক মারধর করে গুরুতর আহত করে ট্রলারে থাকাা মাছ,জাল ও মিশিনের বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রাংশ লুট করে নিয়ে গেছে। জলদস্যূদের হামলায় অনেক জেলে আহত হয়ে মানবেতর জীবণ যাপন করছে। বর্তমানে ‘বিচ্ছু বাহিনী’ ও “বতইল্যা বাহিনী” সাগরে জলদস্যুতা করছে। এই দুই জলদস্যু বাহিনীর কাছে জিম্মী উপকুলীয় এলাকার সব ফিশিং ট্রলার। তাদের নিকট থেকে টোকন না নিয়ে সাগরে যেতে ভয় পাচ্ছে জেলেরা। টোকেন বিক্রি করে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা আদায় করে চলেছে এই দুই বাহিনী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দুই বাহিনীকে প্রতিমাসে বোট মালিক ও মাঝিরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতো। কোনো মাসে চাঁদা দিতে না পারলে নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার। আর এ চাঁদার টাকা লেনদেন হতো মোবাইল ব্যাংক বিকাশ-এর মাধ্যমে। ফলে জলদস্যুদের হাতে জেলে পরিবার গুলো সব সময় জিম্মি থাকে।এব্যাপারে একাধিক ট্রলার মালিকরা জানান, নিয়মিত মাসোহারা দিতে অপারগ হলে পরবর্তি এই ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া মাত্রই ওই জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জলদস্যুরা ট্রলারের ইঞ্জিন,জাল,আহরন কৃত মাছ,তেল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি লুট করে নিয়ে যায়। খালি ট্রলারটি ফুটো করে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। ফলে কিছু মাঝি মাল্লারা সাতাঁর কেটে তীরে ফিরে আসলেও অনেকে সাগরে প্রান হারায়। অনেক সময় জলদস্যুরা মাঝি মাল্লাদের অস্ত্রের মুখে অপহরন করে জিম্মী করে মুক্তিপন আদায় করে।
অনেক জেলেরা জানান, সাগরে মাছ ধরে কোন রকম সংসার চালাতাম। কিন্তু এই দুই বাহিনী সাগরে জলদস্যূতার ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে যেতে পাচ্ছি না। তিনি আরো জানান,এলাকায় অন্য কোন ছোটখাটো ব্যবসা করার মতো নেই কোন সামর্থ্য। ফলে ৯ সদস্যের পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধহারে মানবেতর জীবন যাপন করছি। সম্প্রতি সাগরে এই দুই বাহিনীর সম্বনয়ে গড়া জলদস্যূরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত সাগর থেকে ফিশিং বোট কুলে ফেরারপথে জলদস্যূদের কবলে পড়ে স্বর্বশ্ব হারাচ্ছে। জলদস্যূদের হামলায় নিহত ও আহত হচ্ছে ফিশিং বোটের শ্রমিকরা। এনিয়ে জেলেদের মাঝে চরম আতংক বিরাজ করছে।
স্থানীয় জেলেরা জানান,এলাকার কিছু মুখোশধারী জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্বনয়ে গড়া উক্ত সিন্ডিকেটটি দুই বাহিনীর সম্বনয়ে গড়া এসব জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা প্রত্যক্ষও পরোক্ষ ভাবে এসব জলদস্যুদের সহায়তা করে আসছে বলে একাধিক সূত্রে প্রকাশ। তাছাড়া এ চ্যানেল দিয়ে মায়ানমার থেকে আসা বেল্ডার লবন,বিভিন্ন ব্রান্ডের বিদেশী মদ,সিরামিক পণ্যসহ এবং এখান থেকে মায়ানমারে যাচ্ছে ডিজেল,জন্ম নিয়ন্ত্রন বডি পাচার করছে উক্ত নিন্ডিকেটটি। মায়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যের দস্যুদের সঙ্গে এদের মোবাইলে যোগাযোগ থাকায় সিন্ডিকেটের সঙ্গে বনিবনা না করে কোন চালান পাচার হতে গেলে দস্যুরা এসব ট্রলার উপকুলে নিয়ে এসে মালামাল খালাস করে নেয়। অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের ভয়ে কক্সবাজার জেলার অন্যন্ত ৫০’ হাজার জেলে চরম আতংকে জীবনবাজি রেখে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে। ফলে অলস সময় কাটাচ্ছে জেলেরা। জলদস্যুদের কবল থেকে ফিরে আসা একাধিক জেলেরা জানায়, বিশেষ করে সোনাদিয়া,ঘটিভাংগা,ধলঘাটা,মাতারবাড়ী,কালারমার ছড়া ,চকরিয়া ও কুতুবদিয়া এলাকার একটি সঙ্গবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রন হয় এবং পুলিশের র্সোস পরিচয় দানকারী বেশ কয়েক জন ব্যক্তির সঙ্গে এ সিন্ডিকেটের যোগসুত্রতা রয়েছে বলে সুত্রে প্রকাশ।
এব্যাপারে মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ বাবুল চন্দ্র বণিক বলেন, গভীর বঙ্গোপসাগরে তড়িৎ গতিতে অভিযান পরিচালনা করার মত থানা পুলিশের নিজস্ব কোন দ্রুত নৌযান না থাকায় পুলিশ ইচ্ছা করলেও জলদস্যুদের আটক কিংবা গ্রেফতার করতে পারছেনা। একদিকে সোনাদিয়া দ্বীপ উপজেলা সদর থেকে অনেক দুরত্ব হওয়ায় এবং সরাসরি গাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা এবং অপরদিকে দ্বীপটির চারদিকে সাগর বেষ্টিত হওয়ার কারণেই পুলিশ তড়িৎ গতিতে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহন ও জলদস্যুদের গ্রেফতারের করা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছার অনেক আগেই জলদস্যুরা আনোয়াশে নিরাপদে গা ঢাকা দিতে সক্ষম হয়। তার পরেও পুলিশ ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে একাধিক জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে জোর তৎপরতা চলছে এবং জলদস্যূতা বন্ধে মহেশখালী চ্যানেলের আশে পাশে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে কোস্টগার্ড়কে অবহিত করা হয়েছে এবং সোনাদিয়া চ্যানেলে নৌ বাহিনীর টহল জোরদার করা হবে।
পাঠকের মতামত