ইসলামী উইন্ডো থেকে গ্রাহকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ
সোনালী ব্যাংক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপকসহ টাকা লুট করলেন কর্মকর্তারা
আলমগীর কবির ২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে একটি ঋণের জন্য আবেদন করেন। আবেদন যাচাই বাছাই করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তিনি জানতে পারেন, ২০১৯ সালেই তার নামে ১০ লাখ ৮৬ হাজার টাকার একটি ঋণ অনুমোদন হয়ে গেছে। বিষয়টি জানার পর যাচাই করতে গেলে ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এটা অন্য আলমগীর।
আলমগীর কবির সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম ইসলামী উইন্ডো থেকে বিতরণ হওয়া অনেকগুলো ভুয়া ঋণেরই একটি উদাহরণ। নিজস্ব নিরীক্ষায় এমন ২৮টি ঋণ ধরা পড়েছে, যেখানে গ্রাহক জানেনই না তাদের নামে ঋণ বরাদ্দ হয়েছে, টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে নানা কায়দায় সোনালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ইসলামী উইন্ডো থেকে ১৮ কোটি ৮১ লাখ ১ হাজার ১৩৫ টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। উপমহাব্যবস্থাপক থেকে ক্যাশ কাউন্টারের সিনিয়র কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে এই অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে খোদ সোনালী ব্যাংকেরই একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে এসবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপককে (উত্তর) লিখিতভাবে বলা হয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর এই চিঠি দেওয়া হয়।
কীভাবে এসব ভুয়া ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, যারা ঋণের জন্য আবেদন করেন, মূলত তাদেরকে কৌশলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওই আবেদন ও জাতীয় পরিচয়পত্র কাজে লাগিয়ে ভুয়া ঋণ মঞ্জুর দেখান এবং এসব টাকা কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেন। এ ধরনের ২৮টি ঘটনা উদ্ঘাটন করেছেন কর্মকর্তারা। সেখানে দেখা গেছে, কেবল একজন জুনিয়র অফিসারের একক স্বাক্ষরেও অনেক সময় ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। পরে দেখা গেছে, ওই জুনিয়র
অফিসার তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশেই ওই ভুয়া ঋণের আবেদনে স্বাক্ষর করেন।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার মহাব্যবস্থাপক (উত্তর) মো. মুসা খান আমাদের সময়কে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা এরই মধ্যে আমাদের কাজ শুরু করেছি। মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে এসব কাজ চলে আসছিল। তাই বিষয়গুলো উদ্ঘাটনে আমাদের একটু গভীরে যেতে হচ্ছে।
গত ২৪ জানুয়ারি দৈনিক আমাদের সময়ে ‘সোনালী ব্যাংক পিএলসি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ তবুও যুক্তরাষ্ট্রে বদলির প্রক্রিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুরো বিষয়ে নিরীক্ষা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেরিয়ে আসে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের বড় চিত্র।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১৩ মার্চ সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের বিশেষ নিরীক্ষা এবং ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় প্রতিবেদন মিলে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে দুইজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন- কোর্ট শাখার ম্যানেজার মো. পারভেজ হোসেন ও সিনিয়র অফিসার আরিফা আফরিন।
মো. পারভেজ আহমেদের বিরুদ্ধে আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ইসলামী উইনডোতে কাজ করার সময় সাতটি ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ৬২ লাখ ২৩ হাজার ২০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
একই শাখায় সেকশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আরিফা আফরিন নিজে এবং মো. শাহজাহানের নামে দুটি হিসাবে ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩১ টাকা আত্মসাৎ করেন। আরিফা আফরিন ও পারভেজ আহমদ পরস্পরের যোগসাজশে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ইসলামী ইউন্ডোতে এফডিআর দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন। আরিফা আফরিন ছিলেন আগ্রাবাদ অফিসের সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ)।
সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ইসলামী উইন্ডোতে কর্মরত থাকাকালে ৩৯টি ছোট ছোট ভুয়া ঋণ দেখিয়ে ২ কোটি ৪ লাখ ৭২ হাজার ৭৫২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে আরিফা আফরিনের বিরুদ্ধে। আরিফা আফরিন নিজের নামে ভুয়া ঋণ নেন ১৯ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ফখরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক ঋণের হিসাব বন্ধ করার জন্য আরিফাকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা নগদে দেন। কিন্তু ওই টাকা হিসাবে জমা না করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এর বাইরে নিয়ম না মেনে ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ৭২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ক্ষতিরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ছাড়া ইসলামী উইন্ডোতে কাজ করার সময় তিনি দুটি ব্যক্তিগত হিসাব খোলে ৮৬ লাখ ২৭ হাজার ৫২৪ টাকা আত্মসাৎ করেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৫৮টি চেকের ৪৩ লাখ এবং মুনাফার ৪৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই সময় নিরীক্ষা কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসেন এসব ঘটনা তদন্ত করে দায়মুক্তি দেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে নিরীক্ষা কার্যক্রমে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধেও ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
মো. মঈন উদ্দিন ভুয়া গ্রাহক দেখিয়ে ছয়টি আলাদা হিসাবে ২২ লাখ ৩ হাজার ৪৮১ টাকা আত্মসাৎ করেন। বর্তমানে তিনি পাঁচলাইশ শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে আছেন।
ফাতেমা শাহিনুর চৌধুরী ছিলেন আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার। তিনি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোতে ব্যাংকিং নিয়মনীতি পরিপালন না করে ১৫ জন ভুয়া গ্রাহকের নামে ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৮ টাকা আত্মসাৎ করেন। তার বিরুদ্ধে বিধি বহির্ভূতভাবে সাত গ্রাহকের কাছে ২৯ লাখ ২১ হাজার ৬৪ টাকা বিতরণের অভিযোগ আনা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। আগ্রাবাদ করপোরেট কার্যালয়ে দাপ্তরিক আদেশে তিনি ছিলেন মনিটরিং কর্মকর্তা। কিন্তু সঠিক মনিটর না করায় ভুয়া হিসাব খুলে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
একই কার্যালয়ের কর্মকর্তা থাকাকালে ইমাম হোসেন মজুমদারের বিরুদ্ধে ভুয়া গ্রাহক দেখিয়ে দুটি হিসাবে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
উপমহাব্যবস্থাপক মো. মনির হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি ভুয়া হিসাব খুলে সাড়ে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা উত্তর প্রিন্সিপাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
আগ্রাবাদ করপোরেট অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনকালে মো. আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, এসআইবিএল থেকে পাওয়া চারটি পে-অর্ডার সোনালী ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আবাবিল সফটওয়্যারে না করে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে জমা করে ৮৬ লাখ ২৭ হাজার ৫২৪ টাকা আত্মসাৎ করেন। আসাদ বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক।
সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক নুরুন নবী অবসরে গেছেন। তার বিরুদ্ধে ১৫টি ভুয়া গ্রাহক সাজিয়ে ৬৩ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি শাখা ব্যবস্থাপকের অনুমোদন না নিয়ে ২২ লাখ ৪ হাজার ১৫৪ টাকা ঋণ বিতরণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন। সূত্র দৈনিক আমাদের সময়
পাঠকের মতামত