প্রতারণার মাধ্যমে দেশি বলে চালানো স্বাদ-গন্ধহীন মিয়ানমারের ইলিশ এবার অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বর্ষবরণের আনন্দ।
দেখতে অবিকল দেশি ইলিশের মতো, যা কিনে ঠকেছে সারা দেশের মানুষ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষ বেশি প্রতারিত হয়েছেন। বিষয়টিকে দেশের ইলিশ সম্পদের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে দেশীয় বাজারে ইলিশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি রফতানিতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
দেশে বর্তমানে চলছে ইলিশের অকাল মৌসুম। নদী-সাগরে ইলিশ নেই বললেই চলে। এমন সময় বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে দেশে বেড়ে যায় এর চাহিদা। পহেলা বৈশাখের বাজার সামাল দিতে বেশ কয়েক মাস ধরেই ইলিশ মজুদ করে রাখে বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কিছু ব্যবসায়ী। চৈত্রের শেষ ভাগে তা বাজারে ছাড়া হলেও চাহিদার তুলনায় ছিল কম। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। মিয়ানমার থেকে আনা গন্ধহীন বিস্বাদ ইলিশ দেশি বলে বাজারে ছেড়ে দেয় তারা। বেশ চড়া দামে এসব ইলিশ বিক্রিও হয় বাজারে। দেখতে অবিকল দেশি ইলিশের মতো হওয়ায় তা কেনে সাধারণ মানুষ। রান্না এবং খাওয়ার টেবিলে বসার পর ধরা পড়ে প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি।
বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন কুট্টি বলেন, ‘মিয়ানমার আর বাংলাদেশের ইলিশ পাশাপাশি রাখলে কোনটা দেশি আর কোনটা বিদেশি তা বোঝার উপায় নেই। এমনকি ইলিশ ব্যবসায়ীরাও অনেক ক্ষেত্রে আলাদা করতে পারেন না।’
সিকদার ফিশ ট্রেডিংয়ের মালিক জহির সিকদার বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে দেশে কেজির চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ খুব একটা মিলছে না। অথচ মিয়ানমার থেকে যে ইলিশ বাংলাদেশে আসে তাতে আড়াই থেকে ৩ কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া যায় খুব সহজে। তাছাড়া দেশি ইলিশের তুলনায় এর দামও খানিকটা কম হওয়ায় না বুঝেই সেই ইলিশ কিনে ঘরে ফেরে মানুষ।’
ভাই ভাই মৎস্য আড়তের মালিক খলিলুর রহমান বলেন, ‘যেখানে দেশের নদী-সমুদ্রে বর্তমানে দেখা নেই ছিটেফোটা ইলিশের সেখানে এবার পহেলা বৈশাখের আগে বিশাল বিশাল সাইজের ইলিশে সয়লাব ছিল বাজার। মিয়ানমার থেকে আসা ওইসব ইলিশের কারণে মার খেয়েছে দেশীয় বাজার। আমাদের কাছে টুকটাক যা মাছের চালান এসেছে তার সিকি ভাগও বিক্রি করা যায়নি।’
ইলিশ মোকামের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, বরিশালের ৩ জন ব্যবসায়ী ঢাকার আড়ৎ থেকে মিয়ানমারের ইলিশ এনে এখানে বিক্রি করে। কেবল পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে গত কয়েক দিনে প্রায় ১ থেকে দেড়শ’ টন ইলিশ তারা সরবরাহ করেছে বরিশালে।
বরিশালে মিয়ানমারের ইলিশ এনে সরবরাহ করা ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ও খুলনার ৪ থেকে ৫ জন আমদানিকারক মিয়ানমার থেকে আমদানি করেন এ ইলিশ। আমি সংগ্রহ করি ঢাকার কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের কাছ থেকে। বরিশালের অন্য দু’জনও ঢাকা থেকেই এনেছে মিয়ানমারের ইলিশ। জাকির হোসেন কোন আমদানিকারকের কাছ থেকে এ ইলিশ আনেন তা জানা নেই। তবে শুনেছি ঢাকার তপন বাবু ও লিটন বাবু নামে দু’জন আমদানিকারক মিয়ানমার থেকে ইলিশ আনেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ বলেন, ‘যতদূর শুনেছি এবার পহেলা বৈশাখে ৫ হাজার টনের বেশি মিয়ানমারের ইলিশ ঢুকেছে বাংলাদেশে। এর অধিকাংশ বিক্রি হয়েছে রাজধানী ঢাকায় এবং বাকিটা সারা দেশে।’
দেশের বাজারে এভাবে অবাধে মিয়ানমারের স্বাদ-গন্ধহীন ইলিশের প্রবেশকে ভয়ঙ্কর বিপদ হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এতে দেশীয় ইলিশ মারাত্মক সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
বরিশাল মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল বলেন, ‘বেশ ক’বছর ধরেই পহেলা বৈশাখ আর জামাইষষ্ঠীসহ নানা পার্বনে ছিটেফোটা মিয়ানমারের ইলিশ আসত। কিন্তু এ বছর যা হল তা দেশের ইলিশ সম্পদের জন্য মহা অশনি সংকেত। এভাবে স্বাদ-গন্ধহীন ইলিশ বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নীতিমালা আছে কিনা তাও আমাদের জানা নেই। তবে এখনই এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মহা বিপদে পড়ব আমরা।’