শৈশবকাল থেকে দেখছি আমাদের পাশের আরাকান অঞ্চল জ্বলছে। সেখান থেকে নির্যাতন-নিপীড়নে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এখন বৃদ্ধ বয়সেও এসে দেখছি সেখানে বাংলা ভাষাবাসী রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চলছে। শুধু মুসলিমদের উপর নয়, চাটগাঁইয়া বাংলা ভাষাবাসী সেখানকার হিন্দু বাসিন্দাদের উপরও নৃশংসতা চালানো হচ্ছে। বলা যায়, বর্তমানে নির্যাতনের মাত্রা বর্বরতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। মানুষকে বিভৎস নির্যাতনে, পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। নারীদের উপরও চূড়ান্ত বর্বরতা চালানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। এমনকি দুধের শিশুদের উপরও চালানো হচ্ছে এমন নির্যাতন, যা অতীতের সকল বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। এ কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এসব মানুষকে আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে চলেছি আর বর্বর জাতি বার্মিজদের নির্যাতন দেখে শুধুই চোখের জল ফেলছি। এভাবে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি!
স্বাধীনতার আগে আমার যখন শৈশবকাল, তখন হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে আরাকানের এক কথিত রাজার সাথে পালিয়ে আসতে দেখেছি। এর আগে পরে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসেছেন। যারা আর ফিরে যাননি। তারা এদেশের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়ে এখানেই স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। অনেকেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে চলেছে।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, স্বাধীনতার আগে থেকেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে স্থায়ীভাবে আবাস গাড়লেও আরাকান অঞ্চল শান্ত হয়নি। বরং ধীরে ধীরে আরাকান থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা এদেশের মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে আর তাদের জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের নেতারা এদেশে বড় বিত্তশালী, শিল্পপতি বা জমিদার হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। যেন এপারে পালিয়ে আসাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বপ্নিল ভবিষ্যত! এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশীদের সাথে মিশে যাওয়াই কি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান? বার্মিজ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের পরিকল্পনাতো তা-ই। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে, বাঙালী মুসলিম ও হিন্দু রাজপুত সৈন্যরা মিলে নাকী বৌদ্ধদের নিধন করে বার্মা দখল করেছিল। সুতরাং ওরা বহিরাগত। ওদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূল করতে হবে! মিয়ানমারের মিলিটারির এ জাতিগত নির্মূল অভিযানে সহযোগীর ভূমিকায় লিপ্ত রয়েছে একদল উগ্র বৌদ্ধ, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের মূল উপজীব্য ‘জীবে হত্যা মহাপাপ, অহিংস পরম ধর্ম’- এর বিশ্বাসের সাথে ওদের কত ফারাক।
কিন্তু প্রশ্ন হল, মিয়ানমারের এ ধারাবাহিক মিথ্যা প্রচারণার পেছনে যে উদ্দেশ্যটি রয়েছে, অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা; যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তার প্রধান ভিকটিম হবো আমরাই, এর পাল্টা আমাদের পরিকল্পনা কী? সেই কৌশল কি আমরা স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও প্রণয়ন করতে পেরেছি? আমার জানামতে বাংলাদেশের সরকারগুলো এ বিষয়টিকে কোন গুরুত্বই দেয়নি বা এর গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। অথচ এই সময়ে কত ধরনের কতপন্থী সরকার এলো-গেলো! ফলে আগের অন্তত ৫ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা মাথায় নিয়েও এখন বোঝার ভার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নিকট অতীতের কথা যদি টানতে যাই, তাহলে আমরা দেখি ৭৮ সালে শহীদ জিয়ার আমলে ও ৯১ সালে বেগম জিয়ার আমলেও প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে এসেছিল। যাদের মধ্যে কিছু অংশ ছাড়া বাকীদেরকে আমরা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু কূটনৈতিক ব্যর্থতায় গত এক যুগ ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এখন শুধুই বোঝা বাড়ছে। তাহলে আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? তা এখন খুঁজে বের করার সময় এসেছে। একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নাগরিকের মতোই দেশের স্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এবিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কীভাবে বাংলা ভাষাবাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজদেশেই নিরাপদে টিকিয়ে রাখা যায়, যাতে এদেশের উপর বাড়তি বোঝা তৈরী না হয়- সেটাই হবে পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য।
আমরা লক্ষ্য করছি, ইউরোপ-আমেরিকায় কোন সমস্যা বেশিদিন জিইয়ে রাখা হয় না। তারা দ্রুত সেই সব সমস্যা সমাধান করে ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বার্মায় কেন ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এমন আগ্নেয়গিরি জ্বালিয়ে রাখা হল? এই সমস্যা জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কি? বিশ্ব নেতাদের পরিকল্পনা কি? আমার অজানা। তবে ভয় হয়, এক অজানা ভয়। এনিয়ে অশান্তির দাবানল আমার দেশেও ছড়িয়ে পড়ুক, তা কোন বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়। এ কারণেই ভয়।
তবে বিশ্ব নেতাদের বা বিশ্বের শক্তিশালী জাতিগুলোর যে পরিকল্পনাই থাকুক না কেন, এর প্রধান ভিকটিম হিসাবে বাংলাদেশের উচিৎ নয় কি এ ব্যাপারে একটি দীর্ঘস্থায়ী কার্যকর ভূমিকা রাখার? একটি দীর্ঘস্থায়ী টেকসই কৌশল প্রণয়ন করার? এখানেই দরকার জাতীয় ঐক্যমত্য। তাহলে ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমাদের জাতীয় স্বার্থে কোন বিভক্তি তৈরী হবে না। আমরা সকল বাংলাদেশী একযোগে একটি সংকট মোকাবেলার জন্য তৈরী থাকব।
প্রাথমিকভাবে এবিষয়ে আমি প্রস্তাবনা রাখছি, বর্তমানে সীমান্তে বা সাগরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে সীমান্তবর্তী একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাংলাদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হোক। নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে বাংলাদেশীদের সাথে মিশে যেতে না পারে সেজন্য তাদেরকে নিবন্ধনের তালিকায় আনা হোক। সেসাথে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী দূত পোল গঠন করে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হোক, যাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পায় আর আমরাও শরণার্থী ভারমুক্ত হই।
লেখক: শাহজাহান চৌধুরী
সাবেক হুইপ, সভাপতি - কক্সবাজার জেলা বিএনপি।