এখনো মনে পড়ে প্রায় ৩৮ বছর আগের পটিয়া মাদ্রাসার সেই পাঠাগারের কথা। পাঠ্য পুস্তক/কিতাব পড়ার পাশাপাশি যেখানে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে বিশ্ববরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মণিষী, লেখক, মুফাসসীর, মুহাদ্দিস ও ফকিহ গণের। বর্তমানের প্রত্যাহিক ঝামেলার ফাঁকেও সেই পাঠাগারে গিয়ে পড়া লেখার ইচ্ছে করে। কিন্তু ‘টাইম এন্ড টাইড ওইট ফর নান’ সময় এবং স্রোত যে কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
ইসলাম বিরোধী চিন্তা চেতনা, শিরক-বেদায়াত ও অজ্ঞতা-মূর্খতার সয়লাব প্রতিরোধে আলেম ওলামা, ওয়ায়েজ, দায়ী, লেখক ও খতীবদের কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান ও সহিহ ইসলামী চিন্তা চেতনায় সুসজ্জিত করে সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখার মানসে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পটিয়া জমিরিয়া বর্তমান আল জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসরণে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন আল্লাহর অলি আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহেমহুল্লাহ। মুফতি সাহেব হুজুরের পরে আল জামেয়া ইসলামিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মুর্শিদে কামেল হাজী মুহাম্মদ ইউনুচ (প্রকাশ হাজী সাহেব হুজুর)। তাঁর দীর্ঘ দায়িত্ব পালনকালে এই প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং প্রসারতা লাভ করেছে। একইভাবে ৩য় পরিচালক আল্লামা হারুন ইসলামাবাদীর সময়ে এর অগ্রগতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪র্থ পরিচালক হযরত মাওলানা নূরুল ইসলামের সময়ে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যবান পরিচালক হলেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল হালিম বোখারী।
পটিয়া মাদ্ররাসায় পড়ার সময় আরো স্মৃতি আছে আমার। স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভবত সৌদি আরবের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতীব। ওই সময় একদিন তিনি পটিয়া আল জামেয়া ইসলামিয়া পরিদর্শনে এলেন। মাদ্রাসার পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হল হৃদ্যতাপূর্ণ জমকালো সংবর্ধনা। এখনো মনে আছে আমরা মাদ্রাসা থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে ছিলাম। মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানানোর পুরো আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত আরবী সাহিত্যিক, মুহাদ্দিস ও প্রখ্যাত শায়ের (কবি) আল্লামা সোলতান যাউক নদভী। তিনি তখন আল জামেয়ার শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম দারুল মায়ারিফ আল ইসলামিয়ার পরিচালক।
তখন আল জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মদ্রাসায় ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম আমি। মুফতি মুহাম্মদ ইব্রাহীম রঃ ছিলেন পটিয়া মাদ্রাসার প্রধান মুফতি। আরবি, ফার্সি ভাষায়তো বটেই ইসলামী বিভিন্ন জটিল বিষয়েও ছিল তাঁর গভীর ভূতপত্তি। অসংখ্য আরবি/ফার্সী কিতাব এবং জটিল বিষয়ে সহজ ভাষায় নোট বা সমাধান লিখে আমাদের মত দূর্বল ছাত্রদের শুধু নয় শত শত ওলামায়ে কেরামসহ সাধারণ মানুষের উপকার করেছেন তিনি। বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু প্রকাশনা বাজারে আছে তাঁর। এ গুলোর অনেক বই/কিতাব কাউমী মাদ্রাসার পাঠ্য সিলেবাসভূক্ত।
ইসলামী শরীয়ার অনেক জটিল কিতাবের দরস দিতেন তিনি। আমার সহপাঠীদের মধ্যে (অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী) ড. রশিদ রাশেদ, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাষ্টিবোর্ডের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী প্রফেসর ক্বাজী দ্বীন মুহাম্মদ ও (দিনাজপুর বাংলা হিলির) প্রিন্সিপ্যাল শামসুল হুদা খানসহ অনেকেই ছিলেন তখন। আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান, মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া, শিক্ষাবিদ মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ও হাফেজ মাওলানা আব্দুল গফুরসহ অনেকেই ছিলেন।
একদিন ইসলামী শরীয়ার প্রামাণ্য গ্রন্থ হেদায়া আখেরাইন কিতাবের বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সুদ সংক্রান্ত বিষয়ে পাঠ দিতে গিয়ে তিনি (মুফতি সাহেব হুজুর) হঠাৎ করে আবেগ প্রবণ হয়ে বলতে লাগলেন কারো কারো মতে মাওলানা মওদূদীকে গালি দিলে নাকি বেহেস্ত পাওয়া যাবে! এটি কোথায় আছে? তখন মাওলানা মওদূদীর লিখিত (উর্দু ভাষায়) রেসালায়ে সুদ (বাংলা অনুবাদ সুদ ও ইসলামী ব্যাংকিং) বইটি উপরে তুলে ধরে আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি বইটি সুদের মাসালা সম্পর্কে এত বেশী পরিপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের ইতিহাসে এ সংক্রান্ত (জামে-মানে অর্থাৎ সংযোজন বিয়োজনের প্রয়োজন হবে না) এমন বই অতীতে কেউ লিখেনি। ভবিষ্যতেও আর কাউকে লিখতে হবে না। আমরা তন্ময় হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম আর ভাবছিলাম পটিয়া মাদ্রাসার গন্ডিতে তো মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ। কিন্তু এখানকার প্রধান মুফতি সাহেবের কাছে মাওলানা মওদূদী ও তাঁর প্রকাশনার এত কদর! তা হলে নিশ্চই মাওলানা মওদূদী অনেক বড় আলেম, লেখক এবং দার্শনিক। এই ঘটনাটি গোটা কাউমী মাদ্রাসা অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।
বাস্তবে তখনো আমি মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না বা চিন্তাও করতাম না। এই দিনের পর থেকে দেখাগেল মাদ্রাসার কিছু ভাল ছাত্র মাওলানা মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভাবতে শুরু করল। তারা মাওলানা মওদূদীর লেখা বিভিন্ন বই ও প্রকাশনা সংগ্রহ করতে লাগল। আমরা মাওলনা মওদূদীর লেখা বিভিন্ন বই ও প্রকাশনা সংগ্রহ করা শুরু করলাম। মাদ্রাসার পুরানো মূলভবনের পশ্চিমের সদর গেইটের উপরে ১ম তলায় ছিল দারুল হাদিস, ২য় তলায় ছিল দারুত তাফসীর, ৩য় তলায় ছিল বিশাল পাঠাগার। ওই পাঠাগারে বই/কিতাবের সংখ্যা হাজার হাজার। ওই পাঠাগার থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় ও ভাষার কিতাব সংগ্রহ করে অধ্যয়ন করতাম। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও তর্কবিতর্কে জড়াতাম। সঠিক সমাধানও খুঁজে বের করতাম। ৪র্থ তলায় ছিল বড়সড় একটি তালাবদ্ধ ঘর। ৪র্থ তলায় বলে কদাচিৎ আমরা সেখানে যেতাম।
একদিন কেউ যেন বললেন, তোমরা মাওলানা মওদুদীর বই খুজঁতেছ অথচ ৪র্থ তলার তালাবদ্ধ ঘরটি মাওলানা মওদুদীর লেখা বইতে ঠাঁসা। একদিন আমরা কয়েকজন সেখানে গিয়ে দেখি তালাবদ্ধ ওই কক্ষের উপরে একটি সাইনবোর্ড লাগানো। সাইনবোর্ডের লেখাগুলো ছিল আরবী ভাষায়। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ওস্তাদ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর লিখিত গ্রন্থাগার। ওই পাঠাগারের দেখা শুনার দায়িত্ব যার ছিল (নামটা মনে নেই) তাঁকে আমরা অনুরোধ করলাম আমাদের জন্য ওটা যেন খুলে দেয়া হয়। তিনি আমাদের জানালেন কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে এখান থেকে বই ইস্যু করতে। তবে সপ্তাহে একদিন পরিষ্কার পরিচ্ছনতার সময় এখানে এসে বই দেখতে পার। অগত্যা আমাদের অনেকেই বড় পাঠাগারের পাশাপাশি মাওলানা মওদুদীর প্রকাশনা ভান্ডারেও সেভাবে বিচরণ করতো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মাদ্রাসার অনেক হুজুর তুলনামূলক অধ্যায়নের জন্য ওই পাঠাগার থেকেও বিভিন্ন বই নিয়ে যেতেন।
মাওলানা মওদূদী রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে তাফসীর গ্রন্থ তাফহীমুল কোরআন, সীরাত গ্রন্থ সীরাতুন্নবী সঃ, ইসলাম পরিচিতি, ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা, আল জিহাদ ফিল ইসলাম, রেসালায়ে সূদ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বইগুলো ছাত্রদেরকে বেশী পড়তে দেখেছি। তবে সত্যের সাক্ষ্য (শাহাতদতে হক), ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি (তাহরিকে ইসলামীকি আখলাকী বুনিয়াদিঁ) ও ভাঙ্গা গড়া (বনাও আউর বিগাড়) ছোট্ট পুস্তিকা গুলো আমার ভুল ধারণা নিরসন করেছে। সমাজতান্ত্রিক নেতা মাও সেতুং এর ধর্ম বইটি যেমন আমাকে আলোড়িত করেছিল, তেমনি মাওলানা মওদূদীর সেই পুস্তিকা গুলো আমার ভুল ধারণা নিরসনে সহায়ক হয়েছিল। তুলনামূলক অধ্যয়নের সুবাদে কয়েকটি তাফসীর গ্রন্থের সাথে আমার কিছুটা পরিচিতি হয়েছে বলাযায়। যেমন, তাফসীরে ইবনে কাছির, তাফসীর বায়জাবী, তাফসীরে মায়ারিফুল কোরআন, তাফসীরে জালালাইন, তাফহীমুল কোরআন, তাফসীর ফি জিলালিল কোরআন, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে আশরাফী ও তাফসীরুল কোরআন ইত্যাদি। এখনো চেষ্টা করি নিয়মিত কোরআন-হাদীস পড়ে জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলামের সমাধান জানতে। সমস্যা হচ্ছে, কক্সবাজারে তেমন বড় কোন পাঠাগার নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বিরাট ইসলামী সাহিত্য ভান্ডারের সহযোগিতা নিয়ে থাকি।
এই পুস্তিকা গুলোতে মাওলানা মওদূদী একটি ইসলামী সমাজ/রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যারা বা যেদল কাজ করবে তাদের যে যোগ্যতাও গুণাবলীর কথা বলেছেন তা অবশ্যই বাস্তব। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর আজকের অধিকাংশ নেতারা সেই গুণাবলী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এখনো পটিয়া মাদ্রাসায় সেই পাঠাগার আগের মত প্রাণ চঞ্চল আছে কি না আমার জানানেই। #
## লেখক : সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী গবেষক।মোবাইল : ০১৮১৯-১৭০১৯০। e mail: [email protected].