মুহাম্মদ শামসুল হক শারেক
ছোট বেলা থেকেই বাবার তাগিদে হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা করতাম। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য বাবার অনেক তদবীর ছিল। সিবা বাঁশের শাখা দিয়ে কলম তৈরী করে দিতেন। এগুলো দিয়ে লিখতে হত। বাজারের কলম দিয়ে লিখতে দিতেন না বাবা। লেখা সুন্দর করার নাকি এটাই পদ্ধতি।
বাজার থেকে প্যাকেট কালি এনে দিয়ে দোয়াত ভর্তি করে কালি বানিয়ে রাখতেন। এক লাইন করে খাতায় লিখে দিতেন। এগুলো দেখে দেখে সকাল বিকাল লিখে বাবাকে দেখাতে হত। খেলা ধুলা বা কোন কারণে একদিন না লিখলে আমাকে শুধু নয় এ জন্য মা‘কেও আমার জন্য বকুনী শুনতে হত। শুনেছি আগে নাকি মানুষ কাগজের অভাবে কলা পাতার উপরও লেখত। বাংলা, ইংরেজী, আরবী বলতে কোন কথা নেই। সেই থেকে কোন সুন্দর লেখা দেখলে এখনো আমি ওটা রপ্ত করার চেষ্টা করি। আঙ্গুল দিয়ে টেবিলে অথবা কলম দিয়ে কোন রাফ কাগজে লেখতে চেষ্টা করি।
তখন থাকতাম চাকমারকুল মাদ্রাসার হোষ্টেলে। ফজর নামাজের পর এক সকালে রাস্তার পাশে নাস্তা করতে যাই। রাস্তায় দেখি বড় বড় বাংলা সাদা অক্ষরে ‘হরতাল’ লেখা। আরো দেখি হরতাল পালনের আহবান জানিয়েছেন সিরাজ সিকদার। সিরাজ সিকদারকে তো আমি চিনিই না। হরতালের মাহিত্য ও বলতে গেলে তখন বুঝি না। রাস্তায় চুনা দিয়ে বড় বড় সুন্দর অক্ষরে ‘হরতাল’ লেখা দেখে আমি খুবই আকৃষ্ট হই। মাদ্রাসায় গিয়ে চক পেন্সিল দিয়ে আমার রুমের দরজায় এবং দেয়ালে বড় অক্ষরে ‘হরতাল’ লিখে লেখাটা রপ্ত করছিলাম। ছাত্রদের অনেকেই এ নিয়ে বলাবলি করছিল। ইতোমধ্যে এ খবর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের নিকট চলে যায়।
মাদ্রাসার মুহতামিম (পরিচালক) ছিলেন মরহুম মাওলানা সোলাইমান হুজুর। মরহুম মাওলানা আখতার কামাল হুজুর (মুহতামিম সাহেবের বড় ভাই) ছিলেন মোহাদ্দিছ। মরহুম মাওলানা হোছাইন আহমদ (ভাইস চেয়ারম্যান) হুজুর, মাওলানা জাকের হুজুর, মাওলানা ফুরকান হুজুর (বর্তমানে চট্টগ্রাম দারুল মায়ারিফের সহকারী পরিচালক) ও মাওলানা ছৈয়দ আকবর হুজুর সবাই মিলে জরুরী সভা ডেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। হুজুরেরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন আসলে মাদ্রাসায় হরতার হচ্ছে কিনা। সব হুজুরেরা আমাকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। ফুরকান হুজুর আমার কাছে হরতাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। ধরা পড়ল আমার বোকামি। তাই শুনতে হল বকুনি। তখন হুজুরের কাছে জানলাম সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টির নেতা। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার প্রধান। সরকারের বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম-অসঙ্গতি নিয়ে সিরাজ সিকদারের এই হরতাল। পরিবেশ পরিস্থিতি ভাল না। কেউ এ সব ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। সিরাজ সিকদারের দেশব্যাপী এই হরতাল দুঃসাহসিক। তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এ সব পলিটিক্যাল বিষয়ে জড়াতে চায়না।
সেই হরতাল দেখেছিলাম রাস্তায় কোন মানুষ ছাড়া। এরশাদ আমলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেখেছি পুলিশ-সেনা সদস্যদের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় মানুষের ঢল। ওসময় কক্সবাজার শহরের লালদীঘির পাড় থেকে একটি মিছিলে আমিও শরিক হয়ে সেনা সদস্যদের ধাওয়া খেয়েছিলাম। বিএনপির আমলেও দেখেছি হরতালে রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও দেখাগেছে হরতালের সময় রাস্তায় মানুষ। তবে সেই সময়ের হরতাল আর এসময়ের হরতালে অনেক তফাৎ হয়েগেছে। হয়ত সেসময়ে হরতালকে বিবেচনা করা হত সরকারের নানা অসঙ্গতির প্রতি জনগণের চুড়ান্ত অনাস্তা হিসেবে। সেই অনাস্তার ইফেক্টও কমবেশী দেখাগেছে।
আর এখন হরতালকে সম্ভবত বিবেচনা করা হয়ে থাকে বিদ্রোহ হিসেবে। এখন হরতালে যুক্ত হয়েছে বোমা, আগুন বোমা, রামদা-কিরিচ, লগি-বৈঠা। তাই হয়ত সরকারও লাঠিপেটা ছাড়াও গুলি, টিয়ারশেল ও কামান দাগিয়ে হরতালের প্রতিরোধ করে থাকে। আমি বুঝিনা দেশের-জনগণের জানমাল ও সম্পদ বিনষ্টকারী এই ধরণের ‘হরতাল’ কার স্বার্থে ? সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংসদে বিল পাশ করে ‘হরতাল’ নিষিদ্ধ করা দরকার।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতের ডাকে টানা ১৮/২০ দিনের হরতাল চলছিল। একই সময় ঢাকায় চলছিল তাবলীগ জামায়াতের বিশ^ ইজতিমা। কিএকটি জরুরী কাজে তখন ঢাকা যেতে হচ্ছিল। কক্সবাজার থেকে ছিল সব ধরণের যানবাহন বন্ধ। চট্টগ্রাম থেকে চালু ছিল ট্রেন আর সীমিত আকারে বিআরটিসি বাস। এক বন্ধুসহ নৌ পথে ঢাকা রওয়ানা দিলাম। শহরের কস্তুরাঘাট থেকে যাত্রীবাহি ট্রলারে রাতে জীবনের প্রথম কুতুবদিয়া পৌঁছলাম। সকালে ওখান থেকে আরেক নৌকায় চট্টগ্রাম সদরঘাট পৌঁছে ষ্টেশন রোডে গিয়ে ট্রেন অথবা বাস ধরার অপেক্ষা করছিলাম। ট্রেন ধরতে নাপেরে হুড়–হুড়ি করে জানালা দিয়ে ঢুকে একটি বিআরটিসি বাসে দু’টি সিট দখল করে ঢাকা গিয়েছিলাম।
ঢাকা থেকে ফিরতে পড়েছিলাম আরেক বিড়ম্বনায়। হরতাল চলছিল, আমার কাজ শেষ হতে হতে তাবলীগ ইজতিমাও শেষ। একসাথে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা থেকে ফেরার বিড়ম্বনা বলে শেষ করা কঠিন। অগত্যা আমি ট্রেনের ছাদে উঠে চট্টগ্রাম এসেছিলাম। শীতকালে সারারাত ট্রেনের ছাদে চড়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা সেই এক নরক যন্ত্রণা। শীতকালে ধানক্ষেতে কুয়াশায় শেয়াল ভেজার মত সেই কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে।
১৯৭৫ সালে ১৫আগষ্টের সকাল বেলা। তখন আজকের মত মিডিয়ার প্রসার ছিলনা। মাদ্রাসা হোষ্টেলে রেডিও-টিভির খবর পাওয়া সহজ ছিল না। তাই রাতে ঢাকায় সংঘঠিত বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর আমরা জানতে পারিনি। মাদ্রাসায় নিয়মিত যাতায়াত করত একজন ক্ষৌর কর্মকার। নাম ধাম তার মনে নেই। ছাত্ররা তার কাছেই চুল দাড়ি ঠিক-ঠাক করতো। মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে এসে চিৎকার দিয়ে বলে ‘অ কা বঙ্গবন্ধু নাই’। তার কাছেই আমরা জানলাম রাতে সেনা বিদ্রোহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে মারা গেছেন। অত সব রাজনৈতিক মারপ্যাচ আমি বুঝি না। দেশের প্রধানমন্ত্রী সপরিবারে মারা গেলেন এজন্য আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। এত বড় হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ অথবা দেশবাসীর পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হলনা কেন ? এ নিয়ে (সেই ছোট বেলায়) আমার মনে দু’ ধরণের প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। হয় বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যস্থায় দেশবাসী খুশি ছিল না। নতুবা দেশের মানুষ ছিল চরম অকৃতজ্ঞ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সরকার প্রধান সপরিবারে নিহত হল আর দেশবাসী নিরব! এতে দেশ ও জাতির মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাড়াঁল ? আমার ছোট মনে এসব ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না।
এই মাদ্রাসায় সহপার্টিদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর কাজী দ্বীন মুহাম্মদ। তিনি এখন চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যায় এর ট্রাষ্টি বোর্ডের এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী। কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আজিজুল হক। প্রচণ্ড ভাল ছাত্র মোশ্তাক আহমদ এখন সৌদি আরবে প্রবাসী। আহমদ হোছাইন, মুহাম্মদ তৈয়ব ও জাফর আলম উল্লেখযোগ্য। তারা তিনজনই শিক্ষকতায় নিয়েজিত।
## লেখক : সাংবাদিক, লেখক, ইসলামী গবেষক। মোবাইল : ০১৮১৯-১৭০১৯০। e mail: [email protected].