মুনজুরুল করিম
বিদেশে যেতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু গিয়ে ২/৩ দিন থাকার পর আর ভালো লাগে না। শুরু হয় দেশে ফেরার ক্ষণ গণনা। আজ (৫ অক্টোবর ২০১৬) ব্যাংকক থেকে রওনা দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানটি যখন বাংলাদেশের আকাশে প্রবেশে করলো, তখন থেকেই ভালো লাগার আবেশে মনটা ভরে গেলো। সেই আবেশ নিয়েই ঢাকায় এসে নামলাম। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার বেশ কিছুক্ষণ পর লাগেজ আসলো। এবার বাসায় যাবার পালা। একটু এগোলেই স্ক্যানার মেশিন। দেখলাম, বেশিরভাগ লোকই স্ক্যানারকে পাশ কাটিয়ে অবলীলায় চলে যাচ্ছে। আমি যেচে গিয়ে স্ক্যানার মেশিনে কর্মরত কর্মকর্তাদের বললাম, ‘আমার ব্যাগ কি স্ক্যানারে দেবো?’ তারা বললো, ‘হ্যাঁ, দেন’। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে অন্যেরা যে চলে যাচ্ছে?’ এ প্রশ্নের তেমন কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না তারা। ওদিকে স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দিয়ে আমার ব্যাগ পার করা হলো। শুরু হলো হয়রানির প্রথম পদক্ষেপ। একজন এসে আমার ব্যাগে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিলেন। এবার অবাক হবার পালা। নিজস্ব কিছু প্রয়োজনের জিনিস আর আত্মীয়-স্বজনের জন্য উপহার ছাড়া অতিরিক্ত কোন কিছুই তো আমরা কিনিনি।
যাই হোক, নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবার রওনা দিলাম কাস্টমস বিভাগের ডেস্কের দিকে। সেখানে ব্যাগ খুলে দেখাতে হবে। আবার কিছুটা ভয়ও লাগলো। কারণ, ব্যাগের ভেতরে কৌশলে অন্য কেউ কোন অবৈধ জিনিস ঢুকিয়ে দেয় এমন গল্পও তো অনেক শুনেছি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ডেস্কে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিয়ম মানার আপ্রাণ চেষ্টা আর কি! এর মধ্যে আশেপাশের লোকজন আমাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু করেছে। কেউ কেউ হয়তো আমাকে চিনে থাকতে পারে। এর মধ্যে একজন নিজের জায়গা ছেড়ে আমাকে সামনে দিয়ে দিলো। যে ডেস্কের সামনে গেলাম, সেখানে একজন নারী কর্মকর্তা অন্য একজনের ব্যাগের জিনিসপত্র, পরিমাণ এবং বৈধতা পরিমাপ করতে ব্যস্ত। তিনি সে কাজ শেষ করে আমার ব্যাগের দিকে নজর দিলেন।
ব্যাগ খোলার পর একের পর এক ব্যবহারের জন্য কেনা ব্যাগ আর স্যান্ডেল বেরিয়ে আসতে লাগলো। যিনি পরীক্ষা করছিলেন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত জোড়া স্যান্ডেল আর কতগুলো ব্যাগ আছে’? আমরা বললাম, ‘আত্মীয়-স্বজন আর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে, গোনা নেই। চাইলে আপনি গুনতে পারেন।’ এবার মনে হলো তিনি আমাকে ধরার মতো কিছু পেয়েছেন। বললেন, ‘এতগুলো তো আপনি আনতে পারবেন না’। আমি বললাম, ব্যবহারের জন্য আনতে পারবো না? আত্মীয়-স্বজনের জন্য আনতে পারবো না? তাহলে আপনিই বলেন, ২ জন মানুষ ঠিক কতগুলো আনতে পারবে?’ তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। বললেন, ‘আপনাকে ট্যাক্স দিতে হবে’। আমি বললাম, ‘দেবো- তবে আমাকে আইন দেখাতে হবে। কারণ, আমি তো এক ভরি স্বর্ণও আনিনি বা ১০টা টেলিভিশন বা ১৫টা স্মার্ট ফোনও আনিনি’।
এসব প্রশ্ন চলতে চলতে আরেক কর্মকর্তা এসে বললেন, ‘আপনি বরং আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন’। এবার আমি সেই কর্মকর্তার কাছে গেলাম। সেই কর্মকর্তা তার কাছে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তা বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে আগের কর্মকর্তা এসে বললেন, ‘স্যার আমি উনাকে চিনি। উনি একজন ভালো সাংবাদিক’। আমি বললাম, ‘নাহ, আমি আমার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এখানে আসিনি। একজন সাধারণ যাত্রী হিসেবেই ব্যাপারটার সুরাহা করতে চাই।’
তারপর দীর্ঘক্ষণ কথা এগিয়ে যেতে লাগলো। সেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বার বার আমাদের আনা ব্যাগ আর জুতা-স্যান্ডেলের সংখ্যা জানতে চান। কিন্তু আমি বলতে পারি না। কারণ, সেসব আমরা আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের নাম ধরে ধরে কিনেছি। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর ঐ দুই কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, আমি ব্যবসা করার জন্য ব্যাগ আর জুতাগুলো আনিনি। কতটা হাস্যকর হতে পারে চিন্তা করুন! প্রথমত, তারা আমাকে চিনেছেন। দ্বিতীয়ত, তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে- আমি ব্যবসা করার জন্য ওগুলো আনিনি।
কিন্তু সমস্যা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। কারণ, ঐ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বুঝতে পারছেন না যে- কি সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। এবার আমি বললাম, ‘আপনি ট্যাক্স ধরেন। কিন্তু এক একজন মানুষ বিদেশ থেকে আসার সময় এসব পন্য কি পরিমাণে আনতে পারবে সেই নিয়মটা আমাকে জানান’। এবার একটা সমাধানের পথ এলো। জানা গেলো, প্রত্যেক ব্যক্তি যৌক্তিক পরিমাণে আনতে পারবে এসব পণ্য। তার মানে? ব্যাপারটা তো আরো জটিল হয়ে গেলো। তাহলে সেই যৌক্তিক পরিমাণটা কে ঠিক করবে? আমি তো আমার যোক্তিক পরিমাণে আনতেই পারিনি। এর মধ্যে আরেকজন বললেন, ‘স্যার, ধরা যাক নিজের ব্যবহার এবং উপহারের জন্য প্রত্যেকে যদি ৮ জোড়া করে জুতা যদি আনতে পারে তাহলে তো মনে হয়, উনারা নিয়মের মধ্যেই আছেন’। এখন প্রশ্ন হলো, এই ৮ জোড়া কার হিসেবে যৌক্তিক? পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ৫ জোড়া পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। তাহলে যৌক্তিকতা কি তাদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করবে? এটার যদি সুস্পষ্ট নিয়ম না থাকে, তাহলে বিমানবন্দরে এসে মানুষ তো সেবার পরিবর্তে বাঁ.. পাবে।
আমি যেহেতু হয়রানিকে স্বীকার করেই নিয়েছি, তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেই চাই। কিন্তু সময় যত এগিয়ে যেতে লাগলো, ব্যাপারটা ততোই ঘোলাটে হতে লাগলো। সুস্পষ্ট সমাধানে আসতে পারছে না কেউ। শেষ পর্যন্ত সেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে বললেন, ‘ব্যাপারটা আপনার উপর ছেড়ে দিলাম’। মানে? আমি কি আমার নিজের পন্যের উপর নিজের ইচ্ছে মতো ট্যাক্স বসাবো? আমি বললাম, ‘ট্যাক্স ধরেন। আমি ট্যাক্স দিয়ে যাবো। কিন্তু নিয়মটা জানতে চাই।’
এরপর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরেকজন অফিসারকে ডেকে বললেন, ‘নিয়মে যা আসে সেই পরিমাণ ট্যাক্স আরোপ করেন তার উপর।’ আমি বেরিয়ে আসলাম। আমার ব্যাগটা তখনো খোলা, আমার স্ত্রী তখনো বাইরে দাঁড়িয়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবার আমার ব্যাগের উপর OK লিখে বললেন, ‘সমস্যা নেই। আপনি চলে যান।’ পাশে তখনও আরো বেশ কয়েকজন যাত্রী। তাদের ব্যাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। একটু এগিয়ে আসতেই সেই স্ক্যানার মেশিন। নীল জ্যাকেট পরা সেখানকার কর্মকর্তারা আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। কেউ কেউ ব্যাগ নিয়ে সরাসরি বেরিয়ে যাচ্ছে। আর কারো কারো ব্যাগ তারা স্ক্যানারে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
ভাবছিলাম, আমি না হয় এতক্ষণ ধরে তর্ক করতে পেরেছি, নিয়ম সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ এই পথ দিয়ে যাতাযাত করে, তাদের কি হয়! এই নিয়মের কড়াকড়িকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেই নিয়ম প্রয়োগই যদি করতে চান তাহলে তা সবার জানার ব্যবস্থা নেই কেন? তালিকা করে ঝুলিয়ে দিয়েই তো জানতে পারে সবাই। তা না করে ইচ্ছে হলে স্ক্যান করছেন, আবার ইচ্ছে না হলে স্ক্যান করছেন না। ভাবছিলাম, এ কারণেই হয়তো এই বিমানবন্দরে জুতা-স্যান্ডেল বা ব্যাগও পার হতে পারে না। কিন্তু সোনার বার পার হয় যায় খুব আরামে।
লেখকঃ হেড অব ইনভেস্টিগেশন, ইন্ডিপেনডেন্টটিভি
লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত