পবিত্র কাবা মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি ও ইবাদতের প্রধান কেন্দ্র। আর ‘হাজরে আসওয়াদ’ কাবাঘরের দেয়ালে বিশেষভাবে স্থাপনকৃত একটি পাথরের নাম। আরবি ‘হাজর’ শব্দের অর্থ পাথর আর ‘আসওয়াদ’ শব্দের অর্থ কালো। অর্থাৎ কালো পাথর। ‘হাজরে আসওয়াদ’ বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথর। হজ কিংবা ওমরাহ পালন করতে আসা লাখো মুসলমানরা পাথরটিকে চুম্বন করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। হজযাত্রীরা হজ করতে গিয়ে এতে সরাসরি বা ইশারার মাধ্যমে চুম্বন দিয়ে থাকেন। আপনি কি জানেন, পবিত্র কাবা শরীফের যে কালো পাথরে আপনি চুম্বন করছেন। তা কি পুরোটাই হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর কি না?
ইতিহাসের এক অধ্যায়ে, কারমাতিয়ানদের অত্যাচার আর চুরির কাহিনী বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ এই পাথরটির ওপর এক কালো ছায়া ফেলে। আজকের গল্পে থাকবে সেই চুরির কাহিনী।
‘হাজরে আসওয়াদ’ পৃথিবীতে এলো যেভাবে:
জান্নাতি এই পাথরটি পৃথিবীতে কিভাবে এলো- এই ইতিহাস অনেকেরই অজানা। এ বিষয়ে তাফসিরে মাযহারীতে বর্ণিত হয়েছে, আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে চলে আসার পর আল্লাহ তায়ালা ইয়াকুত মর্মর নির্মিত এবং পূর্ব ও পশ্চিমমুখী জমরূদ নির্মিত দরজাবিশিষ্ট বায়তুল মামুরকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন এবং বর্তমানে কাবাঘর যেখানে অবস্থিত তার জায়গায় তা স্থাপন করলেন।
এরপর হজরত আদম আল্লাইহিস সাল্লামকে বললেন, তুমি জান্নাতে যেভাবে এই ঘর তাওয়াফ করতে এবং এই ঘরকে ঘিরে নামাজ আদায় করতে এখানেও সেভাবে নামাজ পড়ো, তাওয়াফ করো। এ সময় বায়তুল মামুরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদকেও পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়।
তাফসিরে মাযহারীর বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম পৃথিবীতে নামিয়ে আনার সময় হাজরে আসওয়াদের রঙ ছিলো একেবারে সাদা এবং এটি আলোকজ্জ্বল ছিলো। তবে জাহেলি যুগে এক পাপী ও অপবিত্র নারীর স্পর্শে পাথরটি কালো হয়ে যায়।
যেভাবে চুরি হয়েছিল বেহেশতের মর্যাদাপূর্ণ এই পাথরটি:
৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ। কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির আল-কারমতি এক ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় মক্কার দরজায়। তার টার্গেট ছিলো মক্কা নগরী আক্রমণ করা। কিন্তু প্রবেশের অনুমতি পেতে সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মক্কায় কোনো অশান্তি সৃষ্টি করবে না। কিন্তু প্রবেশ করেই ভঙ্গ করে তার প্রতিশ্রুতি। হজ্জ্বের প্রথম দিন, যখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুসলমানরা কাবা ঘিরে নামাজে রত, সেই মুহূর্তেই কারমাতিয়ানরা মসজিদ আল হারামে আক্রমণ চালায়।
তার বাহিনীর নির্মমতা ছিল এতটাই বর্বর, যে পবিত্র কাবা শরীফের চত্বরে প্রায় ৩০ হাজার নিরীহ মুসলমান হত্যার শিকার হন।
ইতিহাস বলে, সেদিন তার বাহিনী মৃতদেহগুলো জমজমের কূপে ফেলে দেয়, আর কুরআনের আয়াত নিয়ে অবমাননা করে। এই ঘটনায় কেঁপে ওঠে পুরো মুসলিম বিশ্ব।
কারমতি বাহিনীর অত্যাচারের এখানেই শেষ নয়। তারা কাবা শরীফের পবিত্র হাজরে আসওয়াদ কাবা থেকে চুরি করে বাহরাইনের মসজিদ আল দিরারে নিয়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মসজিদ আল দিরারকে পবিত্র কাবার বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, যেন মানুষ সেখানেই হজ্জ্ব পালন করে। এই ভাবনায় সে একটি নতুন ধর্মীয় কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করে। তবে, তার এই পরিকল্পনা এক মুহূর্তের জন্যও বাস্তবায়িত হয়নি। মুসলিম বিশ্ব তার এই দুরভিসন্ধিকে গ্রহণ করেনি।
এদিকে, পাথরটির চুরি হওয়ার পর, মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাজরে আসওয়াদকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চলতে থাকে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর বিশাল মুক্তিপণের বিনিময়ে কারমাতিয়ানদের কাছ থেকে পাথরটি উদ্ধার করা হয়। অবশেষে আব্বাসীয় শাসকরা পাথরটিকে কাবা শরীফে পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হন। কিন্তু, পাথরটি তখন ৭টি টুকরো হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে যে পাথরটি রয়েছে, তার সঙ্গেই সবগুলো টুকরো রয়েছে।
আবু তাহির আল-কারমতির পরিণতি তার অত্যাচারের মতোই ভয়াবহ ছিল। বলা হয়, তার মৃত্যুর আগে তার শরীর পোকায় ভরে গিয়েছিল, যা তাকে এক মর্মান্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। ইতিহাস মনে রাখে পবিত্রতার উপর আঘাত কখনোই ক্ষমার যোগ্য নয়। এজন্যই হয়তো বলা হয় মহান রব ছাড় দেন তবে ছেড়ে দেন না।
এই পাথরটি দেখলে মনে হয়, আরো কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেলেও, আসমানী বরকত ও আল্লাহর রহমতের প্রতীক হয়ে মুসলমানদের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।