কমান্ডো অভিযানের পর গুলশানের হলি আর্টিজান থেকে অত্যাধুনিক ৫টি পিস্তল, ৩টি একে-২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত শক্তিশালী গ্রেনেডের ৯টি সেইফটি পিন ও ৩০০ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। অত্যাধুনিক ভয়ঙ্কর এ অস্ত্রশস্ত্র দেশে এসেছে গোপন পথে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে। কয়েক দিন আগে রাজধানীর সবুজবাগ থেকে ৩টি বিদেশি পিস্তলসহ চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশি জেরায় তারা জানিয়েছেন, যশোর সীমান্ত থেকে অস্ত্র কিনে এনে তারা ঢাকায় বিক্রি করেন। ৭.৬৫ বোরের পিস্তলগুলো তারা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। অস্ত্রগুলো বেশির ভাগ ভারত ও পাকিস্তানের তৈরি। রাজধানীসহ সারা দেশে এখন ভয়ঙ্কর সব অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মিলছে আগ্নেয়াস্ত্র। বেশির ভাগ অস্ত্রই আসছে সীমান্ত এলাকা থেকে। সহজেই চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে। প্রতিনিয়ত হাতবদলও হচ্ছে এসবের। ভাড়ায় খাটছে অনেক অবৈধ অস্ত্র। এমনকি বৈধ অস্ত্রধারীরাও তাদের অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছেন সন্ত্রাসীদের কাছে। আবার ভুয়া লাইসেন্স দেখিয়েও অস্ত্র কিনছে অনেক সন্ত্রাসী চক্র। এমন এক পরিস্থিতিতে জঙ্গি থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সন্ত্রাসীর হাতে এখন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র শোভা পাচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় উঠতি মস্তানরাই শুধু নয়, ছিঁচকে ছিনতাইকারীরাও ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। ৩০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কেনা ক্ষুদ্রাস্ত্র রাজধানীতে দেদার বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে দেশের অন্তত ৩০টি সীমান্ত রুট দিয়ে ঢুকছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্রের চালান। ভয়ঙ্কর একে সিরিজের অস্ত্র আসছে সমুদ্রপথে। ভারত, মিয়ানমার হয়ে দেশে আসা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। এ কারণে রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে গুলির ঘটনা। গত পাঁচ মাসে রাজধানীতেই শতাধিক গুলির ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি পৃথক কয়েকটি অভিযানে ডিবি ও থানা পুলিশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এসব অস্ত্র ঢাকায় এনেছিলেন।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় যে পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে দেশের অভ্যন্তরে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে। জঙ্গিদের কাছেই রয়েছে অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। ওই কর্মকর্তার মতে, হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিরা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুইসাইড স্কোয়াডের এই সদস্যরা যেসব অস্ত্র এনেছিলেন তারা জানতেন অস্ত্রগুলো তাদের আস্তানায় আর ফিরবে না। এতেই বোঝা যাচ্ছে তাদের কাছে আরও কত অস্ত্র রয়েছে।গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারা দেশে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী রয়েছেন। সীমান্তপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব রুটে সহজেই বাংলাদেশে আনছেন অস্ত্রের চালান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র তৈরি করা হয়। খুন-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ ছিনতাই কাজেও অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। গেল বছর ইতালির নাগরিক তাভেলাকে খুন করার ঘটনায় ব্যবহূত অস্ত্রটিও উদ্ধার করা যায়নি এখনো।আসছে অস্ত্র : দেশের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাবরুম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি ও সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ অস্ত্র আসছে। দেশেও নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে।
সূত্র জানায়, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবসা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। অনেক সময় গডফাদারদের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবৈধ অস্ত্রের কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
অত্যাধুনিক অস্ত্র : দেশীয় অস্ত্র ৩০ হাজার টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় মিলছে অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হওয়া ছোট অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে উগনি কোম্পানির রিভলবার, মাউজার পিস্তল, ইউএস তাউরাস পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল, ইউএস রিভলবার, আমেরিকার তৈরি পিস্তল, নাইন এমএম পিস্তল ও মেঘনাম কোম্পানির থ্রি টু বোরের রিভলবার। সূত্র জানায়, স্প্যানিশ অস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগই আসে বঙ্গোপসাগরের অরক্ষিত উপকূল দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, চীন, ইসরায়েল, জার্মানি ও রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্র আসে ভারত ও মিয়ানমার হয়ে। চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, স্টেনগান, মেশিনগান, সাব-মেশিনগান, কালাশনিকভ সিরিজের একে-৪৬, একে-৪৭, একে-৫৪, একে-৫৬, একে-৭৪ ও এম-১৬-এর মতো ভয়ঙ্কর অস্ত্রও আসছে অহরহ। জাহাজে আসার পর গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলারে করে এসব অস্ত্র নিরাপদে নেওয়া হয়। কখনোসখনো জাহাজে এনে সরাসরি ঘাটে ভিড়িয়েও অস্ত্র খালাস করা হয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা অরক্ষিত থাকায় চোরাকারবারিরা এ রুটটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন।ভুয়া লাইসেন্সেও চলছে অস্ত্র বিকিকিনি : সীমান্তপথ দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ভুয়া লাইসেন্স দিয়েও অস্ত্র বিকিকিনি চলছে। সম্প্রতি এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, কক্সবাজারের বাসিন্দা ফজলুল করিম ও সাহাবুদ্দিন নামে দুই ব্যক্তি রাজধানীর পল্টনের একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান থেকে লাইসেন্স দেখিয়ে একটি এনপিবি পিস্তল কিনে নিয়ে যান। তত্ক্ষণাৎ লাইসেন্সটি পরীক্ষা করে না দেখলেও পরে এর মালিক কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন লাইসেন্সটি ভুয়া। একই ব্যক্তি পরে আবারও লাইসেন্সের নাম বদলিয়ে আরেকটি অস্ত্র কিনতে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচার অভিযোগও রয়েছে অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। গত বছর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এমন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারও করেছিল। এ ছাড়া রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে বৈধ অস্ত্র বাগিয়ে নিলেও তা ভাড়ায় খাটানো হয়। এমন কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ তা তদন্ত শুরু করেছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, এ অভিযোগের জলজ্যান্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন। তার নিজের লোকজনের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল, যা দিয়ে তিনি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। এমন নূর হোসেনের সংখ্যা অনেক।
অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কত : বাংলাদেশে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার—বিডিপিসির গবেষণাসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ১২৮টি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। ওই গবেষণাসূত্রে আরও জানা যায়, আফগানিস্তান বাদে সার্ক দেশগুলোয় ২৫ হাজার কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র আছে, যার পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করে। বাংলাদেশে এ সিন্ডিকেট প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে। এসব অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী অস্ত্রধারী ও গডফাদারদের সবার তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে। কিন্তু পুলিশ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।
পাঠকের মতামত