তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ::
কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আনসার ব্যারাকে এ সময়ে হামলার ঘটনাটি ‘যেনতেন বিচ্ছিন্ন’ কোনো ঘটনা নয়। বরং এটি পরিকল্পিত হামলা এবং এর সঙ্গে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
জেলা পুলিশের প্রধান এ সীমান্ত এলাকাটিতে জঙ্গিদের তৎপরতা নেই বলে দাবি করলেও জেলা প্রশাসক বলছেন, এ হামলায় সশস্ত্র দলের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের মাত্র দুই দিনের মাথায় টেকনাফের এই হামলাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাইছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
সেই সঙ্গে গত বুধবার রাতে মিয়ানমার সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলায় বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবির একটি হেলিপ্যাড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এক দিন পর ঘটল এ হামলার ঘটনা। এ দুটির মধ্যে যোগসূত্রে জানা গেলেও এলাকায় বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
গত বৃহস্পতিবার টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আনসার ব্যারাকে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬৯০টি গুলি লুট করে নিয়ে যায়। তাদের হামলায় ব্যারাকের আনসার কমান্ডার আলী হোসেন নিহত হয়েছেন।
কিছুদিন ধরেই মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। অভিযোগ রয়েছে, নানা কৌশলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দেশি-বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠী শিকড় গেড়ে বসেছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কয়েকটি দেশের লোকজনের আনাগোনার খবরও পাওয়া যায়।
হামলাকারীরা ‘রোহিঙ্গা জঙ্গি’ : কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে আসার পর তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আনসার ব্যারাকে হামলার ঘটনায় ‘ডাকাত গ্রুপ’ জড়িত। তবে তাদের সঙ্গে কোনো শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠনেরও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হামলাকারীরা ‘রোহিঙ্গা জঙ্গি’। গতকাল টেকনাফের নিবন্ধিত নয়াপাড়া ও অনিবন্ধিত লেদা রোহিঙ্গা শিবির এবং উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে ‘রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীই’ আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে।
শিবিরের অনেক বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে জানায়, শিবিরের যেসব যুবককে প্রশিক্ষণের জন্য শিবিরের বাইরে গহিন জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয় তারা সাধারণত খুব কমই শিবিরে ফিরে আসে। রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ (আরএসও) বিদেশি অর্থায়নে রোহিঙ্গা যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ১৮ হাজার একর বনভূমির মধ্যে প্রায় আট হাজার একরই গহিন অরণ্য এবং দুর্গম এলাকা। টেকনাফের বাহারছড়া, মুচনি, রঙ্গিখালী নামক দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আস্তানা গেড়েছে জঙ্গিরা। সেখানেই রোহিঙ্গা যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
টেকনাফের বন এলাকায় দীর্ঘদিন কর্মরত রেজাউল করিম ও আলাউদ্দিন নামের দুজন মাঠ পর্যায়ের বন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, টেকনাফের গহিন অরণ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রধারী লোকজনের আনাগোনা রয়েছে।
শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গারা বলে, তাদের (রোহিঙ্গা জঙ্গি) প্রত্যেকের হাতে হাতেই এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। নামধাম জানলে তাদের হত্যা করা হতে পারে এমন ভয়ে কেউ তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। তারা জানায়, আরএসওর প্রশিক্ষণ নেওয়া জঙ্গিরাই আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে। কুতুপালং শিবিরের আরএসও রোহিঙ্গা আবু তাহের, আবু সৈয়দ, আবু তৈয়ব, মুন্না, রাকিব, নয়াপাড়া শিবিরের রোহিঙ্গা রফিক, দোস্ত মোহাম্মদ, লালু, হারুন, নুক্কা, নুর মোহাম্মদ, হাফেজ সৈয়দসহ আরো অনেকেই জঙ্গিগোষ্ঠীটির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
আনসার ব্যারাকে হামলার পর চলে যাওয়ার সময় কুপিয়ে আহত করা যুবক আব্দুল আমিন (২৭) কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল বিকেলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের ডি ব্লকের বাসিন্দা রফিকের নেতৃত্বে একদল জঙ্গি রোহিঙ্গাই আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে।’
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের নয়াপাড়া ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই হামলা একদম পরিকল্পিত। সাধারণ কোনো অস্ত্রধারী চোর-ডাকাতের দল এমন ঘটনা ঘটাতে যাবে না। তারা নিশ্চয়ই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।’
‘পরিকল্পিত জঙ্গি হামলা’ : কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী আনসার ব্যারাকে হামলার ঘটনাটিকে কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তিনি মনে করেন, মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি ক্যাম্পে গোলা নিক্ষেপ এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির ঘটনার পর পরই টেকনাফ সীমান্তে এ রকম হামলার ঘটনাটি কোনোভাবেই ছোটখাটো ব্যাপার নয়।
সাবেক এই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকার রোহিঙ্গা শিবিরকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই গোপনে জঙ্গি তৎপরতা চলে আসছে। কিন্তু স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এসব ব্যাপারে তেমন সিরিয়াস নয়।’ তাঁর অভিযোগ, সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এলাকায় কেবল ছুটে বেড়ান ইয়াবার চালানের খোঁজে। অথচ ইয়াবার চালানের অন্যতম আস্তানা রোহিঙ্গা শিবির। একদিকে ইয়াবার টাকা, অন্যদিকে বিদেশি জঙ্গিদের টাকায় রোহিঙ্গাদের অনেকে এত দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। তারাই এখন বেপরোয়া।
এ ধরনের আরো ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, অবিলম্বে জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ করা না হলে আরো বিপদ ঘটতে পারে।
গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কাজনক বার্তা : দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গত ছয় মাসে একাধিকবার সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফ সীমান্তে উগ্র রোহিঙ্গাগোষ্ঠীর ব্যাপারেই এসব সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানিয়েছে, সতর্কবার্তাগুলোয় বলা হয়েছে যে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ১৮ হাজার একর বনভূমির মধ্যে কয়েক হাজার একর গহিন অরণ্য এবং দুর্গম এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় বনকর্মীদের আসা-যাওয়াও সাধারণত হয় না। দুর্গম পাহাড়ের নিরাপদ স্থানে এ কারণে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরের অস্তিত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক।
টেকনাফ সাগরপাড়ের বাহারছড়া ইউনিয়নের একটি আলোচিত অরণ্যঘেরা এলাকা-খলিলের ঘোনা। ঘন গাছগাছালি বেষ্টিত এই অরণ্যের পাহাড়েই ছিল জঙ্গিদের একটি বড় প্রশিক্ষণ শিবির। আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরা জঙ্গিরা খলিলের ঘোনা অরণ্যে এসে থাকত। বছর দেড়েক আগেও পুলিশ হানা দিয়েছিল এই খলিলের ঘোনায়।
তবে বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খলিলের ঘোনায় একে-৪৭সহ আরো নানা অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এলাকার বাসিন্দারাই এসবের সাক্ষী।’উদ্বেগ জানিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, বিভিন্ন দেশের, যেখানে জঙ্গিদের তৎপরতা রয়েছে সেসব দেশের নানা লোকজনের গোপন আনাগোনা রয়েছে এই এলাকায়। বিশেষ করে পবিত্র রমজান ও ঈদুল আজহার সময় এসব বিদেশি লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। গেল ঈদুল আজহার সময় তুরস্কের একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কর্মীরা কয়েক কোটি টাকা রোহিঙ্গাদের জন্য বিলিয়েছিল। মওলানা আজিজ সেই টাকায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিলির জন্য কিনেছিলেন কয়েক শ গরু। টেকনাফ থানা পুলিশ সেই সময় ১৯০টি গরুসহ তাঁকে আটকও করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময় পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয় বলে জানান আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ : টেকনাফ-উখিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা চলে এলেও এ ব্যাপারে পুলিশের বিরুদ্ধে নীরব ভূমিকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলেও পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না বলে অভিযোগ আছে।
এদিকে টেকনাফ থানায় তিন মাস আগে যোগ দেওয়া ওসির বিরুদ্ধেই উঠেছে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী কালের কণ্ঠের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ যোগ দেওয়ার পর থেকেই সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। একের পর এক জঙ্গি সম্পৃক্ত ঘটনার তথ্য ওসিকে জানালেও তিনি কর্ণপাত করেন না।’
এই অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য ওসির সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
তবে এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বারবার অভিযান চালাচ্ছি, কিন্তু সন্ত্রাসীদের ধরতে পারছি না।’
পুলিশ সুপার সীমান্ত এলাকায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডের কোনো অস্তিত্ব নেই বলেও দাবি করেন। কালেরকন্ঠ