মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। যেটি জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত। এটা মুসলমানদের কাছে ‘বায়তুল মোকাদ্দাস বা ‘আল আকসা’ মসজিদ নামে পরিচিত। ইসলামি স্থাপনার প্রাচীন এই নমুনাটি মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সমানভাবে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। ঈসা (আ.) এবং মরিয়ম (আ.) এর সাথে প্রাচীনতম ইবাদত গৃহ বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসার সম্পর্ক সুনিবিড়ভাবে জড়িত।
মুসলিমদের কাছে আল আকসা মসজিদ নামে পরিচিত স্থাপনাটি ইহুদিদের কাছে ‘টেম্পল মাউন্ট’ নামে পরিচিত। আল আকসা হচ্ছে- ইসলামের প্রথম কেবলা এবং মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। মসজিদুল আকসায় এক রাকাত নামাজ আদায় করলে ২৫০ অন্য বর্ণনায় ৫০০ রাকাতের সাওয়াব পাওয়া যায়। শেষ জামানার ঘটনাবলির কারণেও এ এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলেই দাজ্জাল ও ঈসা (আ.) এর আগমন ঘটবে।
বিশ্বনবী (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকেই তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। বিশ্বনবী (সা.) মিরাজ গমনের প্রাক্কালে এই মসজিদে সব নবী–রাসুলের ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি ‘ইমামুল আম্বিয়া’ অর্থাৎ সকল নবীর ইমাম ও ‘সায়্যিদুল মুরসালিন’ তথা সব রাসুলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। এ এলাকাটি অসংখ্য নবি–রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবি–রাসুলের কবর রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলটি ওহি অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। আল আকসা মসজিদের গুরুত্বের আরও একটি বড় কারণ হলো, রাসুল (সা) নবুয়ত প্রাপ্তির পর থেকে টানা ১৪ বছর পর্যন্ত আকসা মসজিদই ছিল মুসলিমদের কিবলা। মক্কায় যখন রাসুল (সা.) নামাজ পড়তেন তখন বায়তুল মোকাদ্দাস অভিমুখী হয়ে দাঁড়ালেও ক্বাবাকে তিনি সামনে রাখতেন। হিজরতের ১৬/১৭ মাস পর মহান আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানদের কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মক্কার দিকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়।
বিশুদ্ধ মতানুসারে সর্ব প্রথম আদম (আ.) মসজিদুল আকসার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ইমাম কুরতুবির মতে এই মসজিদটি প্রথম নির্মাণ করেন আদম (আ.) এর কোন এক সন্তান। ইবনে হাজার আল-আস্কালানি নূহ (আ.) এর সন্তান সাম এর কথাও উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে এই মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম (আ.) এর সন্তান নবি ইসহাক (আ.) ও পরিপূর্ণ করেছিলেন নবি সুলাইমান আলাইহিস সালাম। বনি ইসরাইলের ধার্মিক লোকজন এই বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় আল্লাহ তায়ালার উপাসনায় মগ্ন থাকতো।
ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের আমলে জেরুসালেম বিজয় হলে বর্তমান মসজিদের স্থানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারিত হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে খলিফা আল-মাহদি এর পূনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খৃস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতিমি খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন, যা অদ্যবধি টিকে আছে।
১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার পর তারা মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুসালেম পুনরায় জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। আইয়ুবি, মামলুক, উসমানি, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে এর নানাবিধ সংস্কার করা হয়। বর্তমানে পুরনো শহরটি ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইসলামের তৃতীয় বৃহত্তম ঐতিহাসিক এ মসজিদটির ওপর চলছে যায়োনিস্ট ইহুদিদের আগ্রাসন। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে নেয়। এরপর থেকে সেখানকার মুসলিম জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জায়ানবাদী ইসরায়েল একের পর এক মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকা জবরদখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে।
বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরাইলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় তাদের বাঁধাও দেওয়া হয়। এই বিধিনিষেধের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়। কখনও শুধু জুমার নামাজের সময় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। গাজার অধিবাসীদের জন্য বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর। আমরা মহান আল্লাহ তা’আলার দরবারে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই, তিনি যেন আবারো আমাদেরকে কুদস বিজয়ের তাওফিক দেন এবং মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার করার হিম্মত নসিব করেন।
মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর ফেইসবুক ওয়াল থেকে সংগ্রহীত
‘ম্যাসেজ’ বই থেকে
পৃষ্ঠা: ২৪৪-২৪৬
দ্বিতীয় সংস্করণ
পাঠকের মতামত