সাইফুল ইসলাম:;
ক’দিন আগে আমার কিশোরী ভাইঝি পানিতে পড়ে মারা গেল। এজন্য দীর্ঘ সময় কাটাতে হলো গ্রামের বাড়ি গজারিয়ায়। এর আগেও মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেতাম, কাটাতাম এক দুই ঘন্টা, আবার চলে আসতাম শহরে। এবারের মতো এতো সময় কাটানো হয়নি। বাড়িতে ভাইঝির মরদেহ দেখতে আসে অনেকে, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কথা-বার্তা হলো মন খুলে।
আমজাদ মামাও এসেছিলেন সেদিন। আমরা গ্রামে যে ক’জন দল বেঁধে কাটাতাম তাদের মধ্যে আমজাদ মামা অন্যতম। এখন বয়স ৭৫-এর বেশি। বয়সে আমাদের দলের অন্যদের চেয়ে প্রায় ১০ বছর বড়, কিন্তু আমাদের সঙ্গে মিশতো বন্ধুর মতো। তার সঙ্গে কথা হলো মন খুলে। আমার চোখের সামনে তুলে ধরলেন গ্রাম বদলে যাওয়ার চিত্রও। বললেন, আমাদের এই গ্রামে প্রধান দু’টি কাচারিঘর ছিল আপনাদের বাড়িতে আর মুন্সী বাড়িতে। ১৬শ’ পরিবারের এই গ্রামে আরও চার পাঁচটি কাচারিঘর ছিল; কিন্তু তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে সবও হারিয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করি- কাচারিঘরগুলো হারিয়ে গেল কেন?
সে জানায়- গ্রামে এ দু’টি গোষ্ঠীই ছিল প্রধান। দুই গোষ্ঠীর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এ দুই কাচারিঘর। এ কাচারিঘর দু’টোই শাসন করতো গ্রামকে। এ কারণে এসব কাচারিঘর ছিল গুরুত্বপূণ, চোখে পড়ার মতো। গোষ্ঠীর কেউ অন্যায় করলে এর সামনে বিচার-শালিস হতো। ইলেকশনে প্রার্থীরা আসতো এখানেই। আত্মীয়-স্বজন এলেও এখানেই থাকার ব্যবস্থা হতো। কবিগান, পালাগানের আয়োজনও হতো এ দুটি কাচারিঘর কেন্দ্রীক যুব সমাজের উদ্যোগেই। গ্রামের সেই শাসন, আনন্দ-বিনোদনের আয়োজনের ক্ষমতা আর গ্রামে নেই। গ্রামের প্রভাবশালীরা এখন শহরবাসী। ফলে, যে কোনও ঘটনা ঘটলে দরবার বা মীমাংসার জন্য মানুষ চলে যায় শহরের প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজনের কাছে। আর থানা পুলিশ হলে যায় রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে তদবিরের জন্য। কাচারিঘরের আর দরকার কী? তাই ভেঙে পড়েছে গ্রামের সব কাচারিঘর, মানে গ্রামের শাসন-কাঠামো।
অন্য কাচারিঘরগুলো ভেঙে পড়লো কেন? আমজাদ মামাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন- কিছু বড় গৃহস্থ ছিল, তাদের রাখতে হতো বছরওয়ারী কামলা। তাদের কয়েকজনের ছিল এসব কাচারিঘর। এটা ক্ষমতা না, তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বানিয়েছিলেন এসব কাচারিঘর। এখন কৃষিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, এসেছে পাওয়ার টিলার। সেসব পাওয়ার টিলার চুক্তিতে জমি চাষ করে দিচ্ছে, সেচ দিয়ে দিচ্ছে। তাই আর তাদের কাচারিঘরের দরকার নেই। আবারো জিজ্ঞেস করি মামাকে- এসব গ্রামের কি কিছু উন্নতি হয়েছে?
-উন্নতি-অবনতি বুঝিনা। তবে, আপনাদের সময় আপনারা বড় হয়েছেন, বুঝতে পেরেছি যে বড় হচ্ছেন। আপনাদের হাস-মুরগি, কলা-শসা চুরি করা থেকে সব কিছু বুঝতাম। এখন কে কোথায় কিভাবে বড় হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারি না। গ্রামের সেই যৌথ সমাজ নেই, সেই প্রাণচাঞ্চল্য আর খুঁজে পাই না। তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করেন- আচ্ছা বলেন তো, আমাদের গ্রামের যেমন কাচারিঘর হারিয়ে গেছে, ক্ষমতা চলে গেছে শহরে, অন্যান্য গ্রামেরও কি একই অবস্থা? আমি তার কোনও উত্তর দিতে পারি না। শুধু বলি- অন্যান্য গ্রামের অবস্থাও হয়তো এমনই। ক্ষমতা চলে গেছে শহরে, তাই গ্রামে আর কাচারিঘরের দরকার কী?
লেখক: সাংবাদিক
ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে কক্সবাজার। যারা প্রথমবারের মতো কক্সবাজার যাচ্ছেন বা ...
পাঠকের মতামত