মানুষের জন্য কত ভয়ংকর ব্যাপার! নিজ নিজ হাত-পা নিজেদের দুনিয়ার কর্মের সাক্ষ্য দেবে। পরকালের কঠিন মুহূর্তে মানুষের মুখকে সীলগালা করে দেওয়া হবে। যাতে মুখে কোনো কথা বলতে না পারে। মহান আল্লাহর এ ঘোষণাটি হাফেজে কোরআনগণ ২০ তারাবির নামাজের তেলাওয়াত করেছেন। রোজাদার মুসল্লিরা তা শুনেছেন। যারা বুঝতে পেরেছেন, এ ঘোষণায় তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠেছে।
রমজানের ২০ রোজার প্রস্তুতিতে ২৩ পারার তেলাওয়াত সম্পন্ন হয়েছে। আজকের তারাবিতে সুরা ইয়াসিন (২২-৮৩), সুরা সাফফাত, সুরা সোয়াদ, সুরা যুমার (১-৩১) পড়া হয়েছে। এ সুরাগুলো মহান আল্লাহ তাওহিদ রেসালাত আখেরাত এবং আগের নবি-রাসুলদের নবুয়তের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা রয়েছে। বিশেষ করে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জীবনের প্রায় ঘটনাই পড়া হয়েছে আজ। সুরাগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচ্যসূচি হলো-
সুরা ইয়াসিন : আয়াত ২২-৮৩
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাক্কী জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নাজিল হয়েছে সুরা ইয়াসিন। এ সুরায় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতকে অকাট্য প্রমাণ করার পাশাপাশি এ রেসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। হাফেজে কুরআনদের কণ্ঠে পরকালে সেই কঠিন অবস্থার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে; যেদিন মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাদের কর্মে সাক্ষ্য দেবে নিজ নিজ হাত ও পা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৬৫)
হাশরের দিন হিসাব-নিকাশের জন্য উপস্থিতির সময় প্রথমে প্রত্যেকেই যা ইচ্ছা ওজর আপত্তি বর্ণনা করার স্বাধীনতা পাবে। মুশরিকরা সেখানে কসম করে কুফর ও শিরক অস্বীকার করবে। তারা বলবে, 'আল্লাহর শপথ আমরা মুশরিক ছিলাম না' (সুরা আনআম : আয়াত ২৩)
তাদের কেউ বলবে, আমাদের আমলনামায় ফেরেশতা যা কিছু লিখেছে, আমরা তা থেকে মুক্ত। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের মুখে মোহর মেরে দেবেন। অর্থাৎ তারা আর মুখে কোনো কথা বলতে পারবে না। এরপর তাদেরই হাত, পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রাজসাক্ষী করে কথা বলার যোগ্যতা দান করা হবে। তারা কাফেরদের যাবতীয় কার্যকলাপের সাক্ষ্য দেবে। আলোচ্য আয়াতে হাত ও পায়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে।
অন্য আয়াতে মানুষের কান চোখ ও চামড়ার সাক্ষ্য দানের উল্লেখিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ قَالُوۡا لِجُلُوۡدِهِمۡ لِمَ شَهِدۡتُّمۡ عَلَیۡنَا ؕ قَالُوۡۤا اَنۡطَقَنَا اللّٰهُ الَّذِیۡۤ اَنۡطَقَ کُلَّ شَیۡءٍ وَّ هُوَ خَلَقَکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ - وَ مَا کُنۡتُمۡ تَسۡتَتِرُوۡنَ اَنۡ یَّشۡهَدَ عَلَیۡکُمۡ سَمۡعُکُمۡ وَ لَاۤ اَبۡصَارُکُمۡ وَ لَا جُلُوۡدُکُمۡ وَ لٰکِنۡ ظَنَنۡتُمۡ اَنَّ اللّٰهَ لَا یَعۡلَمُ کَثِیۡرًا مِّمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
'জাহান্নামিরা ওদের চামড়াকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন?’ উত্তরে চামড়া বলবে, ‘আল্লাহ যিনি সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরও বাকশক্তি দিয়েছেন।’ তিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁরই কাছে তোমাদের ফিরে যেতে হবে। তোমরা কিছুই গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কান, চোখসমূহ ও চামড়াসমূহ তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে না, বরং তোমরা মনে করেছিলে যে, তোমরা যা কিছু করতে আল্লাহ তার অনেক কিছুই জানেন না।' (সুরা হামীম আস-সাজদা/ফুসসিলাত : আয়াত ২১-২২)
یَّوۡمَ تَشۡهَدُ عَلَیۡهِمۡ اَلۡسِنَتُهُمۡ وَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ اَرۡجُلُهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
যেদিন (পরকালে বিচারের দিন) তাদের জিহবাগুলো, তাদের হাতগুলো ও তাদের পাগুলো তারা যা করতো, সে ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।' (সুরা নুর : আয়াত ২৪)
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, একদিকে আল্লাহ বলেন, আমি এদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেবো এবং অন্যদিকে সূরা নুরের আয়াতে বলেন, এদের কণ্ঠ সাক্ষ্য দেবে এ দুটি বক্তব্যের মধ্যে কীভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যাবে?
এর উত্তর হচ্ছে, কণ্ঠ রুদ্ধ করার অর্থ হলো, তাদের কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে। এরপর তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের মর্জি মাফিক কথা বলতে পারবে না। আর কণ্ঠের সাক্ষ্যদানের অর্থ হচ্ছে, পাপি লোকেরা তাদেরকে কোন কোন কাজে লাগিয়েছিল, তাদের মাধ্যমে কেমন সব কুফরি কথা বলেছিল, কোন ধরনের মিথ্যা উচ্চারণ করেছিল, কতপ্রকার ফেতনা সৃষ্টি করেছিল এবং কোন কোন সময় তাদের মাধ্যমে কোন কোন কথা বলেছিল। সেসব বিবরণ তাদের কণ্ঠ স্বতস্ফূৰ্তভাবে দিয়ে যেতে থাকবে। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে একাধিক হাদিসে এসব ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনাও এসেছে এভাবে-
১. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমরা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ছিলাম। এমন সময় তিনি এমনভাবে হাসলেন যে, তার মাড়ির দাঁত দেখা গেল। তারপর তিনি বললেন, তোমরা কি জানো আমি কেন হাসছি? আমরা বললাম: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। তিনি বললেন, 'কেয়ামতের দিন বান্দা তার প্রভুর সঙ্গে যে ঝগড়া করবে তা নিয়ে হাসছি। সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে কি আপনি জুুলুম থেকে নিরাপত্তা দেননি? তিনি বলবেন, হ্যাঁ, তখন সে বলবে, আমি আমার বিরুদ্ধে নিজের ছাড়া অন্য কারও সাক্ষ্য গ্ৰহণ করবো না।
তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি নিজেই তোমার হিসেবের জন্য যথেষ্ঠ। আর সম্মানিত লেখকবৃন্দকে সাক্ষ্য বানাব। তারপর তার মুখের উপর মোহর মেরে দেওয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হবে। ফলে সেগুলো তাদের কাজের বিবরণ দেবে। তারপর তাদেরকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, তোমাদের ধ্বংস হোক, তোমাদের জন্যই তো আমি প্রতিরোধ করছিলাম।' (মুসলিম)
২. অন্য হাদিসে এসেছে, তোমাদেরকে মুক করে ডাকা হবে। তারপর প্রথম তোমাদের উরু এবং দুই হাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।' (মুসনাদে আহমাদ)
৩. অন্য হাদিসে এসেছে, '...তারপর তৃতীয় জনকে ডাকা হবে। আর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি আপনার বান্দা, আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনার নবি ও কিতাবাদির প্রতিও। আর আপনার জন্য নামাজ, রোজা, সাদাকাহ ইত্যাদি ভালো কাজের প্রশংসা করে তা আদায় করার দাবি করবে। তখন তাকে বলা হবে, আমরা কি তোমার জন্য আমাদের সাক্ষীকে উপস্থাপন করব না? তখন সে চিন্তা করবে যে, এমন কে আছে যে, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়? আর তখনই তার মুখের উপর মোহর মেরে দেওয়া হবে এবং তার উরুকে বলা হবে, কথা বল। তখন তার উরু, গোস্ত, হাঁড় যা করেছে তার সাক্ষ্য দেবে। আর এটাই হলো মুনাফিক। এটা এজন্যই যাতে তিনি (আল্লাহ) নিজের ওজর পেশ করতে পারেন এবং তার উপরই আল্লাহ অসন্তুষ্ট।' (মুসলিম)
শুধু তা-ই নয়,
এ সুরায় সেসব ব্যক্তিদের ভয় দেখানো ও সতর্ক করা হয়েছে, যারা বিশ্বনবির রেসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তাদেরকে কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করে সতর্ক করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাসীদেরকে যুক্তি ও অকাট্য প্রমাণ দ্বারা এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এ সুরায় তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে-
১. তাওহিদ বা একত্ববাদ : প্রাকৃতিক নিদর্শন ও সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে;
২. পরকাল সম্পর্কে : প্রাকৃতিক নিদর্শন, সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি এবং স্বয়ং মানুষের অস্তিত্বের সাহায্যে;
৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে : এ ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে যে, বিশ্বনবি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে অসহনীয় কষ্ট, দুর্ভোগ, নির্যাতন সহ্য করে নবুয়তের মহান দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ দাওয়াত ছিল যুক্তিযুক্ত এবং বিবেক সম্মত। যার মধ্যে সবার জন্য কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
'আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব আমার কাছ থেকে শুনে নাও। তাকে বলা হল, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলল হায়, আমার সম্প্রদায় যদি কোন ক্রমে জানতে পারত- যে আমার পরওয়ারদেগার আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ২৫-২৭)
'তাদের জন্যে একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা থেকে ভক্ষণ করে। আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং প্রবাহিত করি তাতে নির্ঝরিণী। যাতে তারা তার ফল খায়। তাদের হাত একে সৃষ্টি করে না। অতঃপর তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না কেন?' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৩৩-৩৫)
তাদের জন্যে এক নিদর্শন রাত্রি, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়। সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। চন্দ্রের জন্যে আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৩৭-৪০)
জান্নাতিদের জন্য আনন্দের ঘোষণা রয়েছে এ সুরায়। আল্লাহ বলেন-
'এদিন জান্নাতিরা আনন্দে মশগুল থাকবে। তারা এবং তাদের স্ত্রীরা উপবিষ্ট থাকবে ছায়াময় পরিবেশে আসনে হেলান দিয়ে। সেখানে তাদের জন্যে থাকবে ফল-মূল এবং যা চাইবে। করুণাময় পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হবে সালাম।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৫৫-৫৮)
বিচার দিনের অপরাধীদের পৃথক হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ বলেন-
' হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও। হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং আমার এবাদত কর। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বুঝনি? এই সে জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হতো। তোমাদের কুফরের কারণে আজ এতে প্রবেশ কর। আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।' (সুরা ইয়াসিন ৫৯-৬৫)
আবার আল্লাহ তাআলা চাইলে মানুষকে আকার বিকৃতি কিংবা অন্ধ করে দিতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন-
'আমি ইচ্ছা করলে তাদের দৃষ্টি শক্তি বিলুপ্ত করে দিতে পারতাম, তখন তারা পথের দিকে দৌড়াতে চাইলে কেমন করে দেখতে পেত! আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্ব স্ব স্থানে আকার বিকৃত করতে পারতাম, ফলে তারা আগেও চলতে পারত না এবং পেছনেও ফিরে যেতে পারত না। আমি যাকে দীর্ঘ জীবন দান করি, তাকে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেই। তবুও কি তারা বুঝে না?' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৬৬-৬৮)
এ সুরায় মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সম্পর্কে মহান প্রভু ঘোষণা করেন, এটা কোনো কবিতার বই নয়, বরং এটা হলো সেরা উপদেশ গ্রন্থ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مَا عَلَّمۡنٰهُ الشِّعۡرَ وَ مَا یَنۡۢبَغِیۡ لَهٗ ؕ اِنۡ هُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ وَّ قُرۡاٰنٌ مُّبِیۡنٌ
'আমি রাসুলকে কবিতা শিক্ষা দেইনি এবং তা তার জন্যে শোভনীয়ও নয়। এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কোরআন।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৬৯)
মানুষের কল্যাণ উপকারিতা ও নেয়ামতের জন্য আল্লাহ তাআলা পশু-প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-
' আমি এগুলোকে তাদের হাতে অসহায় করে দিয়েছি। ফলে এদের কতক তাদের বাহন এবং কতক তারা ভক্ষণ করে। তাদের জন্যে চতুস্পদ জন্তুর মধ্যে অনেক উপকারিতা ও পানীয় রয়েছে। তবুও কেন তারা শুকরিয়া আদায় করে না? তারা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যাতে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারে।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৭২-৭৪)
সর্বোপরি এ সুরার শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার পবিত্রতা ও রাজত্বের কথা তুলে ধরে তার দিকে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি সতর্কতাস্বরূপ তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
'অতএব পবিত্র তিনি, যাঁর হাতে সবকিছুর রাজত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৮৩)
সুরা সাফফাত : আয়াত ০১-১৮২
ছোট ছোট আয়াতে বর্ণিত চমৎকার অলংকৃত সুরা 'সুরা সাফফাত'। হিজরতে আগে নাজিল হওয়া এ সুরাটিতে রয়েছে ১২৮ আয়াত। এ সুন্দর অলংকৃত বর্ণনা যে কাউকে মোহিত করে।
এ সুরায় সুরে সুরে পূর্ববর্তী নবি রাসুলদের ঘটনাসমূহের ব্যাপক উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্বনবিকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বনবি ও তাঁর সাহাবাদের ওপর যখন প্রচন্ড রকমের নির্যাতন চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে অর্থাৎ মক্কী জীবনের শেষ দিকে এ সুরা নাজিল হয়। এ সুরার মৌলিক বিষয়বস্তুগুলো ঈমান বাড়াতে সহায়ক। আর তাহলো-
> এতে তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাতের বিশ্বাসসমূহ বিভিন্ন পন্থায় উপস্থাপিত হয়েছে।
> মুশকিরদের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহের খণ্ডন করা হয়েছে।
> জান্নাত জাহান্নামের অবস্থাসমূহের চিত্রায়ন করা হয়েছে।
> পয়গাম্বরগণের দাওয়াতের বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
> কাফেরদের সন্দেহ ও আপত্তির নিরসন করা হয়েছে।
> হজরত নুহ, হজরত ইবরাহিম ও তাদের পুত্রগণ, হজরত মুসা, হজরত হারুন, হজরত ইলিয়াস, হজরত লুত ও হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের ঘটনাবলী কোথাও সংক্ষেপে আবার কোথাও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
> মক্কার অবিশ্বাসীরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে অভিহিত করতো, এ সুরার উপসংহারে বিশদভাবে এ ধারণার খণ্ডন করা হয়েছে।
> সবেচেয়ে শিক্ষণীয় বিষয় হলো- হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মহান জীবনেতিহাস সবিস্তার আলোচিত হয়েছে এ সুরায়। যা বিশ্বনবি ও সাহাবায়ে কেরামের জন্য বিপদের মুহূর্তে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।
সুরা সোয়াদ : আয়াত ০১-৮৮
গোনাহ মাফের এ সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এ সুরার পটভূমি হলো- বিশ্বনবির পিতৃব্য আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ না করা সত্ত্বেও তাঁর দেখা-শোনা, হেফাজত ও যথাযথ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। এ সুরার আলোচিত দিকগুলো হলো-
> পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম ও শান ও মানের দ্বারা প্রিয় নবির রিসালাত ও নবুয়তের দলিল প্রমান উপস্থাপন করা হয়েছে। > এ সুরায় হজরত দাউদ, হজরত সোলায়মান এবং হজরত আইউব আলাইহিস সালামের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।
> মক্কার কুরাইশরা আফসোস করে বলতো- যদি আমাদের নিকট কোনো উপদেশ গ্রন্থ নাজিল হতো। তবে আমরা পূর্ববর্তী লোকদের ন্যায় আল্লাহ তাআলার খাঁটি বান্দা হতে পারতাম। তাদের আকঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। যা এ সুরায় আলোচিত হয়েছে।
সুরা যুমার : আয়াত ১-৩১
এ সুরাটিও মক্কায় অবতীর্ণ। সুরাতুল গোরাফ নামেও এ সুরাটি পরিচিত। এ সুরার অধিকাংশ বক্তব্য তাওগিদ সম্পর্কিত। যারা তাওহিদে বিশ্বাস করে, তাদের পুরস্কার; যারা অবিশ্বাস করে তাদের শাস্তির কথাও এ সুরায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতার কলংক শিরক তথা অংশীবাদের বাতুলতা ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।