সম্প্রতি বিভিন্ন হিফজখানায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি কড়া শাসন ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
মুহাদ্দিস রফিক উল্লাহ আফসারির একটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ভাইরাল হলে বিষয়টি নিয়ে বেশ চর্চা শুরু হয়। ওই ভিডিও ক্লিপে আফসারি মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের বিষয়টিকে সামনে আনেন এবং শিক্ষকদের নির্যাতনে অনেক শিশু প্রতিবন্ধী হয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন। তিনি অভিভাবকদের অনুরোধ করেন, কোনো শিশুকে বোর্ডিংয়ে (মাদ্রাসার আবাসনে) দেবেন না। শিশুরা মায়ের কাছে থেকে হিফজখানায় গিয়ে কুরআন শিখবে।
বিশ্লেষকদের মতে, কিছুসংখ্যক মাদ্রাসায় অব্যবস্থাপনা, অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকা প্রভৃতি কারণে অনেক ছাত্র হিফজ শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষকদের দ্বারা নিয়মিত মারধরের শিকার হচ্ছে তারা। অনেক ছাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমগুলোর আর্কাইভে এ জাতীয় বহু ঘটনার ভিডিও রেকর্ড ও প্রতিবেদন জমা আছে।
মাওলানা আফসারির এমন বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছে, সত্যি কি হিফজখানায় অবুঝ শিশুরা এতটা নির্যাতিত হচ্ছে? এ বিষয়ে কী বলছেন আলেম সমাজ? গোটা পরিস্থিতির বিষয়ে আলেম সমাজের বক্তব্য জানতে কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত আলেমের বক্তব্য নিয়েছে যুগান্তর।
আলেম সমাজ রফিক উল্লাহ আফসারির বক্তব্যের মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকে তার বক্তব্যে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আবার অনেকে আফসারি বিপথগামী আলেম বলেও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত কাসেমুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ইব্রাহীম আল-ফরিদী যুগান্তরকে বলেন, ‘হিফজখানার বিষয়ে সম্প্রতি বিষোদগার চলছে। আমি মনে করি না, এভাবে শিশুদের প্রতি নির্যাতন হয়। আমি বিষয়টিকে কওমি মাদ্রাসার প্রতি গভীর ষড়যন্ত্র মনে করি। কারণ আমি তো এমন দেখছি না। আমাদের মাদ্রাসায় আমরা ছোট শিক্ষার্থীদের লোকমা ধরে খাবার খাইয়ে দিই, গোসল করিয়ে দিই। তাদের পরিচর্যা করি। শিশুদের পাঠদানে এ ভালোবাসা, স্নেহ-যত্ন, সৌহার্দ, সৌন্দর্যময় আচরণ কেয়ামত পর্যন্ত আমাদের মাদ্রাসায় জারি থাকবে। কারণ আমরা দ্বীনের ধারক ও বাহক।’
তবে কেন নির্যাতনের এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে? জবাবে মুফতি ইব্রাহীম বলেন, ‘হ্যাঁ, বাচ্চাদের তো শাসনে রাখতেই হবে। কিন্তু যা বলা হচ্ছে তা অনৈতিক, এটা আমাদের উপর অতিরিক্ত দোষ চাপিয়ে দেওয়া। আমি মনে করি ইসলামবিদ্বেষীরা এমন প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের মতো আলেম-ওলামা, হাফেজ যে পরিমাণে আছে বিশ্বের আর কোথাও নেই। এদেশের হাফেজ-ক্কারীরা বিদেশে গিয়ে প্রতিযোগিতায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। এটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না।’
রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগের মুহাদ্দিস, বিশিষ্ট আলেম, লেখক ও গবেষক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন যুগান্তরকে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারেই এগারোজন হাফেজে কুরআন রয়েছেন। আমি মনে করি কুরআনুল কারিমের হিফজ অনেক কষ্টকর ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। আর যারা দিনভর কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাদের ওপর কিছু মানসিক চাপ পড়ে। যে কারণে হিফজের ছাত্ররা বেশি চঞ্চল হয়। ফলে তাদের শাসন করতে হয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনায় কোনো কোনো জায়গায় হয়তো বাড়তি শাসন হতে পারে। কিন্তু সেটাকে প্রতিপাদ্য বানিয়ে হিফজুল কুরআন মাদ্রাসার অসাধারণ অবদান অস্বীকার অথবা অপব্যাখ্যার সুযোগ নেই। তবে এটাও ঠিক যে, শাসনসহ সার্বিক পরিচালনায় আরো উন্নতির প্রয়োজন আছে।’
সাইফুল ইসলাম মাদানী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৩০ হাজার হিফজুল কুরআন মাদ্রাসার মধ্যে কোথাও কোথাও শাসনের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা রয়েছে। যার কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল; কিন্তু এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ফরজে কেফায়া ইবাদতের ব্যাপারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। শাসন করতে গিয়ে যেসব শিক্ষক সীমা অতিক্রম করে ফেলেন, ভুল করে থাকেন, তাদের অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ বিদ্যালয়ের তুলনায় হিফজুল কুরআন মাদ্রাসার রুটিনের পার্থক্যটি মাথায় রেখে আমাদের ভাবতে হবে, সংশোধনের পথ খুঁজতে হবে। অতএব ঢালাওভাবে সমালোচনা মোটেই সমীচীন নয়। এমন কোনো কথা যেন না বলা হয়, যা ইসলামের শত্রুদের হাতিয়ার হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন দোষ-ত্রুটিগুলোকে পাবলিক প্লেসে প্রকাশ করা না হয়, যাতে বাংলাদেশে লাখ লাখ হাফেজে কুরআন তৈরি হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।’
মাওলানা আফসারির অভিযোগটি ঢালাওভাবে সমর্থন না করলেও মাত্রাতিরিক্ত শাসন বা শারীরিক প্রহারের ঘটনা যে অনেক মাদ্রাসায় ঘটে সে বিষয়টি স্বীকার করলেন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার শায়খ আহমাদুল্লাহ।
তার মতে, কুরআন ও হাদিসের আলোকে হাফেজের মর্যাদা সবচাইতে বেশি। বাংলাদেশের হিফজের মানও পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে ভালো। ঢালাওভাবে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এ শিক্ষাদানকে বিতর্কের মুখে ফেলা সমীচীন নয়।
তবে তার মতে, হিফজখানার আবাসিক পরিবেশ ও পাঠদান পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে কথা হতেই পারে কিন্তু এ কারণে হিফজখানার প্রয়োজন অস্বীকার করা কোনোক্রমেই উচিত নয়।
কেন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে- এই প্রশ্নের উত্তরে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘একই সাবজেক্ট, একই শিক্ষক দিয়ে লাগাতার দিন-রাত পড়ানো হয় হিফজখানগুলোতে। এতে অবসাদ বা একঘেয়েমি চলে আসে। ফলে শিক্ষকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। তারা ভুল করে বসেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীও টানা একই সাবজেক্ট পড়ার কারণে তাদের মধ্যেও একঘেয়েমি চলে আসে। অতিরিক্ত চাপ নিতে না পারার কারণে হিফজখানাগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার তূলনামূলক বেশি।’
হিফজখানায় পাঠদানে কড়াকড়ি হয় স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘ক্যাডেট স্কুল-কলেজগুলোতে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কড়াকড়ি অনেক বেশি। এর ফলে তাদের মানও অনেক উন্নত। হিফজখানাগুলোতে পাঠদান পদ্ধতিতে কিছু কড়াকড়ি আছে। সেজন্য সেগুলো থেকে বিশ্বমানের হাফেজে কুরআন বের হয়। কিন্তু তাই বলে শাসন যেন জুলুমের পর্যায়ে না যায়, শরীয়াহর সীমা অতিক্রম না করে সে বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে হবে।’
এজন্য যুগ যুগ ধরে চলে আসা মাদ্রাসার প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতিসহ ব্যবস্থাগত ক্ষেত্রে কিছুটা সংস্কার আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘যুগের চাহিদায় পাঠদানসহ সুযোগ-সুবিধায় নানা পরিবর্তন আনা জরুরি। শুধু হিফজখানা বা মাদ্রাসা নয়; যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান পদ্ধতি, আবাসন, শাসন-ব্যবস্থার সংস্কার হতে পারে। এগুলো পরিবর্তনশীল।’
কেমন হতে পারে সেই সংস্কার- এমন প্রশ্নে বিশিষ্ট এই আলেম বলেন, ‘প্রতিটি মাদ্রাসা, নূরানি ও হিফজখানায় আট ঘণ্টার শিফট পদ্ধতি চালু করতে হবে। ভোর ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একজন শিক্ষকের জন্য পাঠদান কঠিন এবং কষ্টকর। শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন ও বোনাস দিলে মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পাবে তাদের। তারা দুশ্চিন্তা মুক্ত থেকে সযত্নে হাসিখুশি মনোভাবে শিশুদের পড়াবেন। পবিত্র কুরআন হিফজ করার পাশাপাশি সীমিত পরিসরে হলেও অন্যান্য বিষয় যেমন- আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও গণিত শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। এতে শিশুদেরও একঘেয়েমি থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।’
তিনি জানান, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ সর্তক ও বিচক্ষণ থাকতে হবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে। উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে সনদধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। কোনো কক্ষে ঢালাও বিছানায়, বা এক মশারির মধ্যে একাধিক ছাত্রদের রাত্রিযাপনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। সিসি টিভি দ্বারা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ছাত্রদের খেদমতের মানসিকতা তৈরির চেষ্টা থাকা ভালো। তবে কোনো শিক্ষক যেন শিক্ষার্থীদের দ্বারা শারীরিক কোন সেবা না নেন (যেমন- হাত পায়ে তেল দেওয়া, হাত-পা টেপা) সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকতে হবে।
অভিভাবকদেরও কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলে সতর্ক করেছেন আহমাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সনদধারী, ভালো মানের, যেখানকার আবাসন ব্যবস্থা ভালো, প্রতিটি রুমে সিসি ক্যামেরা আছে কিনা, শিক্ষকদের দ্বারা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কিনা সন্তানেরা- তা সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে অভিভাবকদের। বাসা থেকে আসা-যাওয়া করেও হিফজ শিক্ষা নিতে পারে শিশুরা। তবে সে ক্ষেত্রে বাসায় উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে শিক্ষার্থীকে। বর্তমানে হিফজ করানোর পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষা দিয়ে থাকে কিছু মাদ্রাসা। আমরা আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে একটি প্রতিষ্ঠান করার উদ্দ্যোগ নিচ্ছি। যেখানে ১০ বছর ধরে হিফজ করানো হবে। অন্যান্য পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁফে সন্তান কুরআন মুখস্ত করবে। এতে শিক্ষার্থীরা হাফেজের পাশপাশি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারবে এবং বোর ফিল করবে না।’
এ বিষয়ে রাজধানীর ইকরা ইসলামিক একাডেমির শিক্ষা সচিব জুবায়ের আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ফেসবুকে ভাইরাল ইসলামি বক্তা আফসারির একটা খণ্ডিত বক্তব্যে বলা অভিযোগগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ ঢাকার অনেক হিফজ মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছি আমি। কাউন্সিলিং করেছি। প্রায় ছয় বছর একটি হিফজ মাদ্রাসায় পার্টটাইম শিক্ষক ছিলাম। অনিবন্ধিত ও সাধারণ মানের শিক্ষক দিয়ে পরিচালিত কিছু মাদ্রাসায় এসব ঘটে। বলাৎকারের মতো জঘন্য অপরাধ ঘটছে সেখানে। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। তবে আমার অনার্স-মাস্টার্স লেবেলে অন্তত ছয়জন বন্ধু আছেন যারা হাফেজ এবং কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করেছেন। আমার একজন ছাত্র আছে যে আমাদের কাছে হিফজ শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত আমার কাছে প্রাইভেট পড়ে এখন মেডিকেলে পড়ছেন। তাদের মাদ্রাসাগুলোয় এসব হয় না বলে আমার বিশ্বাস।’
তিনি আরও বলেন, ‘হিফজ মাদ্রাসাগুলোর সমস্যা নিয়ে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দেশের বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য আলেমের সাথে কথা বলেছি। তারাও সংস্কার চান; কিন্তু কেউ সাহস করে উদ্যোগ নিতে চান না। মিডিয়ার সামনে সমস্যা নিয়ে কথাও বলতে চান না।’ সুত্র: যুগান্তর