চারদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশির মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে এই দারুচিনি দ্বীপ। ঝড়, ঝঞ্ঝা, উত্তাল তরঙ্গকে সঙ্গী করে টিকে আছে এখানকার প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা। ঝড় ও জলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারলেও রোগশোকের কাছে এরা অসহায়। কেননা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ১০ শয্যার হাসপাতালটি এক রকম অচল হয়ে পড়ে আছে ১৫ বছর ধরে।
কেবল ভিআইপি কোনো ব্যক্তি ভ্রমণে এলে চিকিৎসকদের দেখা মেলে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তাই সুদৃশ্য হাসপাতাল ভবনের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে চিকিৎসার নাজুক অবস্থা। একজন মেডিকেল অফিসার থাকার মতো আবাসিক সুযোগ-সুবিধাও নেই সেখানে। তাই স্বাস্থ্যসেবা বলতে যা বোঝায়, তা আর জুটছে না দ্বীপবাসীর কপালে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান দৈনিক বাংলাকে জানান, ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব ড. জাফর উল্লাহ চৌধুরী হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। হাসপাতালে রয়েছে একটি অপারেশন থিয়েটার। চিকিৎসা-সুবিধার আধুনিক সব যন্ত্রপাতিও আছে। তবে ১৫ বছরেও অপারেশন থিয়েটারের তালা খোলা হয়নি। খোলা হয়নি সরবরাহ করা যন্ত্রপাতির প্যাকেট।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, উদ্বোধনের পর তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স, দুজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, দুজন ফার্মাসিস্ট, ছয়জন ওয়ার্ডবয়, চারজন এমএলএসএস, তিনজন আয়া, একজন পিয়ন, একজন স্টোরকিপার, চারজন ঝাড়ুদার নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় সবাই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। হাসপাতালে ৭৪ লাখ টাকার একটি জেনারেটর থাকলেও সেটিও অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।
এখন ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসক, একজন নার্স ও একজন কর্মচারী দিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালু রাখা হয়েছে।
প্রায় ৯ বছর ধরে অনুপস্থিত সেন্ট মার্টিনে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন। তিনি ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট টেকনাফে যোগদান করে সাত দিনের ছুটি নিয়ে এ পর্যন্ত অনুপস্থিত রয়েছেন। বিনা অনুমতিতে এতদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেননি সংশ্লিষ্টরা।
এতে প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না দ্বীপের বাসিন্দারা। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে এখন রোস্টার বেইসড চিকিৎসাসেবা পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবুল কাশেম। তিনি জানান, ‘একজন ডাক্তার ও একজন স্বাস্থ্য সহকারী দিয়ে সেন্ট মার্টিনের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে টেলিমেডিসিন সেবাও দিয়ে যাচ্ছি টেকনাফ সদর থেকে। লোকবল নিয়োগ দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েকবার চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র ও ইউনিয়ন হলেও এখানে হাসপাতালে গত ১৫ বছরেও ইনডোর সেবা চালু হয়নি। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা ভবনের বেশির ভাগ কক্ষ ফাঁকা পড়ে আছে। মূলত ১০ শয্যার হাসপাতাল শুধু কাগজে-কলমে, বাস্তবে তা নেই বললেই চলে। তবে বহির্বিভাগে সেবার মান আগের চেয়ে বেড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মুরশিদা বেগম বলেন, বর্তমানে এই হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। কিন্তু গর্ভবতী নারীর প্রসবজনিত জটিলতা দেখা দিলে সিজারিয়ান অপারেশনের দরকার পড়ে। তখন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদের উপজেলা বা জেলা সদরে নিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রসব জটিলতায় টেকনাফে হাসপাতালে যাওয়ার সময় মাঝপথে কুলসুমা বেগম (২২) নামে এক গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালের আগস্টে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় দ্বীপের বাসিন্দা স্কুলছাত্র নাসিম উদ্দিন, চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) মো. রুবেলসহ এক কিশোরী প্রাণ হারান। মৃত স্কুলছাত্র নাসিম উদ্দিনের বড় ভাই মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘ছোট ভাইকে সকালে সৈকত থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। সে সময় তার শ্বাস চলছিল। তবে হাসপাতাল বন্ধ থাকার কারণে তাকে কোস্টগার্ডের জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তারা জানিয়েছিল, যদি আধা ঘণ্টা আগে চিকিৎসা পেত তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেত।’ দ্বীপে এভাবে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।
সেন্ট মার্টিন ১০ শয্যার হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক রিয়াদ মো. সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমানে জরুরি সেবা এবং বহির্বিভাগ সেবা চালু আছে। ইনডোর সেবা এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু করা যায়নি। তার পরও যতটুকু সম্ভব আমরা সেবা দিই। হাসপাতালে প্রসূতিসেবা চালু আছে। প্রতি মাসে এখানে সাত-আটটি নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। তবে স্থানীয় মানুষ প্রসবসেবা নিয়ে খুব বেশি সচেতন নয়। তারা বাড়িতেই ডেলিভারি করাতে অভ্যস্ত।’
কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমানে দুজন করে চারজন সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক ওই হাসপাতালে কর্মরত। তারা আউটডোর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আর ইনডোর সেবা চালুর জন্য ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সুত্র : দৈনিক বাংলা