২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে হত্যা, গণধর্ষণ এবং নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে, ধর্ষণ ও হত্যা করে জাতিগত নিধন অভিযান চালায় মিয়াননমারের সেনাবাহিনী। সেসময় নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তারা এখনো তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে পারেনি। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে ২০১৯ সালের নভেমম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। ওই বছরের ১০-১২ ডিসেসম্বর এই মামলায় প্রথমমবার প্রাথমিক শুনানি হয়। এতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির আইন ও বিচার মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। আর মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি। ২০২০ সালে আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার দলিল দাখিল করে গাম্বিয়া। সেখানে দেখানো হয়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কীভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ এনে গাম্বিয়ার করা এ মামলাকে এক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ জানায় মিয়ানমার সরকার। সুচি কারাবন্দি থাকায় এ বিষয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নেন মিয়ানমার জান্তার প্রতিনিধিরা। মিয়ানমারে গত বছর এক অভ্যূঙ্খানে অং সান সুচির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। এখন তারা বেসামরিক লোকদের সশস্ত্র অভ্যূঙ্থান দমন করার চেষ্টা করছে। গত বছর ২৯ শে ডিসেম্বর মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে ইয়াই মিয়েত গ্রামের ওপর চক্কর দিতে থাকে তিনটি হেলিকপ্টার। এতে থাকা সৈন্যদের ওপর আদেশ ছিল গুলি চালানোর। এখনো গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারি লোকজন গুলির শব্দ শুনতে পান। তারা ভয়ে আছেন। ১১ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ, মৌলভি সেলিম উল্লাহ ও জিয়াউর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাবলী চোখের সামনে ভেসে আসছে এবং তারা বলছেন, মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন, লুটপাট, এবং নিরপরাধ লোকদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়াসহ বাবার সামনে উপযুক্ত মেয়েকে ধর্ষণ করার নির্মম কাহিনী। পুরুষদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করতো। বয়স্ক মানুষ ও নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হতো। ১৭ নং ক্যাম্পে থাকা সানজিদা ও মরিয়মের সাথে দেখা হলে তারা বলেন, সেদিন চোখের সামনে স্বামীকে হত্যা করার পর আমাদের ওপর জুলুম করে মিয়ানমার সেনারা। এখানে ক্যাম্পে নতুন করে বিয়ে করেছি। স্বপ্ন দেখি আগামীর পথ চলার। আমাদের সেখানে সুখি পরিবার ছিল। পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা ধান ছিল। আমার আগের স্বামী মংডুতে ব্যবসা করতো। সেই স্মৃতিময় দিনগুলি আমাদের কাদাঁয়। এখানে আমরা অনেক ভালো আছি। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে আত্নীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারি। আমরা নিয়মিত খাবার পায়। ডাব্লিউএফপি আমাদের সকল প্রকার নিত্যপণ্য খাবার দেন। অন্যান্য এনজিওগুলো আমাদের সহায়তা করেন। বাংলাদেশ সরকার আমাদের থাকার জায়গা দিয়েছেন। প্রায় পাঁচ বছর হতে চলছে এখনো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি। যতদিন আমরা আমাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা এবং পরিবেশ পাবো না ততদিন আমরা ফিরে যাবো না। ১৪ বছরের রোহিঙ্গা কিশোরী নুর কায়েদা বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আমার বয়স ছিল ৯ বছর। সেই সময়ের কথা আমার এখনো মনে আছে। মায়ের সাথে দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে তিন দিন পর খেয়ে না খেয়ে আমরা এ দেশে আশ্রয় পেয়েছি। এ বছর আমি এক রোহিঙ্গা তরুণকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। এত কম বয়সে বিয়ে কেন জানতে চাইলে নুর কায়েদা বলেন, ক্যাম্পে এই বয়সেই বিয়ে হয়। আমার আগে অনেক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি যাকে বিয়ে করেছি তাকে আমি ভালবাসি।