নিউজ ডেস্ক::
চলমান রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে থেকে এমন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্নেষকরা। অনেক দিনের নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা দেওয়া হয়। যার অন্যতম রূপকার হিসেবে কাজ করেছেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। এর সঙ্গে আরও রয়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি ঘরানার বাইরে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এরই মধ্যে এই জাতীয় ঐক্য নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে ঐক্য ঘোষণার দিন অসুস্থতার কারণে যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান বি. চৌধুরীর উপস্থিত না থাকার বিষয়টি নিয়েও নানা গুঞ্জন রয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও রাজনৈতিক আলোচনায় বর্তমানে যথেষ্টই গুরুত্ব পাচ্ছে জাতীয় ঐক্যের ঘোষিত পাঁচ দফা দাবি ও ৯টি লক্ষ্য। তবে পাঁচ দফা সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। অন্যদিকে এই জোটকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি।
এদিকে জাতীয় ঐক্যের যৌথ ঘোষণার একটি অংশে ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। বিএনপিপন্থি অনেকে মনে করছেন, যৌথ ঘোষণার এসব কথা তাদের ঐক্য প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার জন্য হয়তো ব্যবহূত হতে পারে। ঘোষণার এ অংশে বিএনপিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে কি-না, তা বিশ্নেষণ করে দেখছেন তারা।
যৌথ ঘোষণার এ অংশসহ বিভিন্ন মতানৈক্য সমাধানের জন্য সংশ্নিষ্ট নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাইছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি নিতেই পারছে না যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম। নির্বাচন-সংক্রান্ত সম্মিলিত বৈঠক করতে না পারায় জোটগত নির্বাচনে তাদের কৌশল ও আসন বণ্টন নিয়েও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তারা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় ঐক্য। সংগঠনের একাধিক নেতা এ কথা নিশ্চিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের অন্যতম শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলছেন, তারা সবেমাত্র ঐক্য প্রক্রিয়া ঘোষণা করেছেন। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি তারা এখনও শুরু করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কী প্রক্রিয়ায় হবে, কীভাবে হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এসব চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না।
এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত চারটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে তিনটি নবম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসনেই তারা জয়ী হতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিকল্পধারা ৬৩টি আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছিল এক লাখ ৪৬ হাজার ৮২৭ ভোট। ৪৫ আসনে প্রার্থী দিয়ে গণফোরামের অর্জন ছিল ৭২ হাজার ৯১১ ভোট। জেএসডি সমানসংখ্যক আসনে প্রার্থী দিয়ে পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৩৫০ ভোট। তিন দলের তিনটি ছাড়া বাকি আসনগুলোতে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
জেএসডির সক্ষমতা ১০০-তে :যুক্তফ্রন্টের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এককভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দেশের প্রায় ১০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বৈঠক হয়েছে। যদিও বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। জেএসডির শীর্ষ নেতারা জানান, তাদের সাংগঠনিক কাঠামোয় প্রায় আড়াইশ’ আসনে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব।
জেএসডির একটি সূত্র জানায়, তাদের দলের সভাপতি আ স ম আবদুর রব লক্ষ্মীপুর-৪ আসন (রামগতি-আলেকজান্ডার) থেকে এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন কুমিল্লা-৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন। দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহসভাপতি এম এ গোফরান লক্ষ্মীপুর-১, আলহাজ এম এ ইউসুফ লক্ষ্মীপুর-২, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বেলাল লক্ষ্মীপুর-৩, মো. ফায়েক উজ্জামান ঢাকা-১৫, এম এ রশীদ ঢাকা-১৭, এম এ মান্নান ঢাকা-২০, এম এ ইউসুফ ঢাকা-৮, কামালউদ্দিন পাটোয়ারী ঢাকা-১১, নুরুল আবছার ঢাকা-৯, মোহাম্মদ মিল্টন হোসেন মুন্সীগঞ্জ-৩, শামসুল আলম খান ময়মনসিংহ-৬, তাজউদ্দিন জামালপুর-৫, নূরে আলম কুমিল্লা-৩, মহিউদ্দিন মিয়া কুমিল্লা-৭ আসনে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া চলছে অন্যান্য আসনেও।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা না থাকলে এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের সমন্বিত সিদ্ধান্ত না থাকলে নির্বাচনে যাবে না তাদের দল। নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, জোটগত নির্বাচন হলে আসন বণ্টনের বিষয় সেখানেই সমাধান করা হবে।
৩০০ আসনেই সক্ষম গণফোরাম :ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন দশম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। আগামী নির্বাচন নিয়ে দলীয় প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এখনও আরম্ভ করতে পারেননি। তবে দলের কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা সুব্রত চৌধুরী বলছেন, তাদের দল গণফোরাম ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। জোটের বৈঠকে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই বিকল্পধারায় :এদিকে, নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক কোনো কার্যক্রম এখনও দৃশ্যমান দেখা যায়নি বিকল্পধারা বাংলাদেশে। তবে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া গঠনের শুরুতে এ দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী আগামী নির্বাচনে দেড়শ’ আসন ভাগাভাগির শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তার এ বক্তব্য সরকারবিরোধী শিবিরে সমালোচনার সূত্রপাত ঘটালে তিনি তার এ বক্তব্য থেকে সরে এসে ভারসাম্যের রাজনীতি দাবি করেন।
সারাদেশে বিকল্পধারার তেমন শক্ত ভিত নেই। তবে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও নোয়াখালীর কয়েকটি আসনে তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে। এসব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা-৬-এ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর-২-এ শাহ আহমেদ বাদল; ঢাকা-১১, নোয়াখালী-৪ ও লক্ষ্মীপুর-৪-এ মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, ঢাকা-৫-এ খালেকুজ্জামান চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-১-এ মাহী বি. চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-৩-এ নুরুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ-৫-এ আবদুর রহিম প্রমুখ।
নিবন্ধিতই নয় নাগরিক ঐক্য :এদিকে, মাহমুদুর রহমান মান্নার সংগঠন নাগরিক ঐক্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত নয়। তাই আগামী নির্বাচনে তাদের স্বতন্ত্র অথবা অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তা ছাড়া দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতা তেমন নেই বললেই চলে। দলটি এর আগের কোনো নির্বাচনে অংশও নেয়নি। তবে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে প্রায় ৩০টি আসনে কাজ করছেন। আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-৬, উপদেষ্টা এস এম আকরাম নারায়ণগঞ্জ-৫ ও ডা. জাহেদ উর রহমান নোয়াখালী-৪ আসন থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, এ মুহূর্তে দাবি আদায়ের জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রমের দিকেই নজর দিচ্ছেন তারা। তবে দলীয়ভাবে কে কোথায় নির্বাচন করতে পারবেন, কে যোগ্য হবেন, তাও চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তবে এ সংগঠনগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টিই নির্ভর করছে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য জোট গঠনের ক্ষেত্রে সফলতার ওপর। ‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে’ নির্বাচন না হলে এসব দলের অনেকগুলোই নির্বাচনে অংশ নেবে না। আবার এই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়ায় বিএনপি যুক্ত হলে দাবি-দাওয়ায় বা আসন বণ্টনেও তারতম্য ভিন্ন হবে বলে জানান জোটের শরিক দলের এক নেতা।
পাঠকের মতামত