নিউজ ডেস্ক::
২৪ আগস্ট মিয়ানমারে কয়েকটি তল্লাশি চৌকিতে একযোগে হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। এরপর থেকে রাখাইনে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। দমন-নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে তাদের ঢল নেমেছে। শুরু হয়েছে বড় সংকট।
নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। চার দিনে (১-৪ সেপ্টেম্বর) টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৩৩টির বেশি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে পালিয়ে এসেছে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা। এর আগের ৮ দিনে এসেছে আরও ৬০ হাজার।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে বলে তিনি জেনেছেন। এত লোক গণনাও সম্ভব নয়। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় একত্রে রাখা, তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, খাদ্যসহায়তা, স্বাস্থ্যসহ সাত দফা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তিনি ঊর্ধ্বতন মহলে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।
এদিকে হুড়োহুড়ি করে নাফ নদী পারাপার করতে গিয়ে গত চার দিনে রোহিঙ্গাবোঝাই ছয়টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত এসব ঘটনায় লাশ উদ্ধার হয়েছে ৫৭টি। কয়েকটি লাশে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছে পুলিশ।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে ভাসছে অসংখ্য মৃতদেহ। রাখাইন রাজ্যে সেনা ও পুলিশ রোহিঙ্গাদের গুলি করে হত্যা করছে। তারপর লাশ নদীতে ফেলে দিচ্ছে। সেই লাশ টেকনাফ উপকূলে ভেসে আসছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী–শিশুরা। ঈদের দিনেও আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে তারা। কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ২ সেপ্টেম্বর তোলা ছবি l প্রথম আলোটেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক দিনে বিজিবি সীমান্তে অনুপ্রবেশের সময় প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রতিরোধ করেছে। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও রোহিঙ্গারা দলে দলে ঢুকে পড়ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি জানান, নাফ নদীতে নৌকাডুবিতে কয়েক দিনে ৫৭ রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে। কিছু লাশ মিয়ানমার থেকে ভেসে এসেছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন খান জানান, মিয়ানমার থেকে জোয়ারে ভেসে আসা কয়েকটি লাশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
সীমান্তে রোহিঙ্গার ঢল
গতকাল সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে হাজারো রোহিঙ্গার ঢল নামে। নৌকা নিয়ে তারা শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, বাজারপাড়া, ঘোলাপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও পশ্চিমপাড়া উপকূল দিয়ে উঠছে। তারপর হেঁটে কিংবা রিকশা ও ইজিবাইকে চড়ে আসছে টেকনাফ শহরে। সেখান থেকে যাচ্ছে উখিয়া ও টেকনাফের একাধিক রোহিঙ্গা শিবিরে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে আড়াই হাজারের মতো রোহিঙ্গা। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় জড়ো করার চেষ্টা চলছে।
শাহপরীর দ্বীপের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন জানান, গত তিন দিনে শুধু শাহপরীর দ্বীপের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে। টেকনাফের আরও কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছে আরও তিন গুণ।
হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ইউনিয়নের উনচিপ্রাং ও লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে কয়েক দিনে ঢুকেছে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। তারা ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।
উখিয়া উপজেলার বালুখালী, রহমতেরবিল, আনজুমানপাড়া, ধামনখালী, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম, তুমব্রু, বাইশারীসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছে আরও ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। উখিয়ার বালুখালীর ঠাইংখালী ঢালা নামক স্থানে ২ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হয়েছে নতুন একটি রোহিঙ্গা শিবির। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সেখানে জড়ো হয় প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। এক কিলোমিটার দূরে বালুখালী ও সাত কিলোমিটার দূরের কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে আরও ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকজনের ধারণা, ২৪ আগস্টের হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তবে এর সঠিক সংখ্যা প্রশাসনের কাছে নেই।
রোহিঙ্গারা জানায়, ২৪ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ। তারা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। রাখাইন রাজ্যের মংগদু জেলার ঢেকিবুনিয়া, চাকমাকাটা, ফরিকরাবাজার, তুমব্রু, কুমিরখালী, বলীবাজার, টংবাজার, সাহাববাজারসহ রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত অন্তত ২৫টি গ্রাম এখন মানুষশূন্য।
গতকাল শাহপরীর দ্বীপে কথা হয় আমেনা খাতুনের (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ভোরে তাঁরা রাখাইন রাজ্যের ফাদনচা গ্রাম থেকে নৌকা নিয়ে এখানে নেমেছেন। যাচ্ছেন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁর আত্মীয়ের কাছে।
উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, রাখাইনে দমন-পীড়নের মুখে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সনাতন ধর্মের হিন্দুরাও বাংলাদেশ পালিয়ে আসছে। উখিয়ার একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছে রাখাইন রাজ্যের ফবিরাবাজার থেকে পালিয়ে আসা ৪৯৭ জন হিন্দু নারী পুরুষ শিশু। উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হচ্ছে না। কত রোহিঙ্গা ঢুকেছে, এ হিসাব কারও কাছে নেই। সুত্র প্রথম আলো
এক নজরে
মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান হামলা শুরু
২৪ আগস্ট ২০১৭
১-৪ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা এসেছে অন্তত
১ লাখ ২০ হাজার
এর আগে ৮ দিনে ঢুকেছে
৬০ হাজার
এ পর্যন্ত মোট
১ লাখ ৮০ হাজার
নাফ নদীতে নৌকা ডুবে মৃত্যু
৩০ আগস্ট ৪
৩১ আগস্ট ১৯
১ সেপ্টেম্বর ২৬
২ সেপ্টেম্বর ৩
৩ সেপ্টেম্বর ৪
৪ সেপ্টেম্বর ১
মোট মৃত্যু ৫৭