কালেরকন্ঠ::
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, হামলা ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের তালিকা বিদেশি দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনে পাঠাচ্ছে বিএনপি। গতকাল রবিবার পর্যন্ত ছয়টি ঘটনার তথ্য-উপাত্ত পাঠিয়েছে দলটি। আরো পাঁচ-ছয়টি ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করছে তারা।
গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি চালুর পর ঘটা ঘটনাগুলোই এসব চিঠিতে স্থান পেয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন নেতা জানান, বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো ছয়টি ঘটনার জন্য ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন পুলিশ সদস্য। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আছেন ১০ জন।
এসব পুলিশ সদস্য ও সরকারি দলের নেতাদের নাম, পদবি এবং ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
গত ৩ জুন বিএনপি ১৪ সদস্যের একটি তথ্য সংগ্রহ কমিটি গঠন করে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এর প্রধান। এই কমিটি ঘটনার বিবরণ, জড়িত পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে চিঠি আকারে তা দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির কাছে হস্তান্তর করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি তা বিদেশি মিশনে পাঠায়।
দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিবাসী আইনের যে অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তার ভিত্তিতে ঘটনাগুলো তুলে ধরা হচ্ছে। নেতারা মনে করছেন, তাঁদের এই উদ্যোগ সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপির এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আগে জেনে নিই, পরে দেখব।
’
তথ্য সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক রুহুল কবীর রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে হামলা, মিথ্যা মামলা ও নেতাকর্মীদের নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনার নেতৃত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা, সদস্য এবং জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে ঘটনার বিবরণ ও জড়িতদের নামসহ চিঠি বিদেশি মিশনগুলোতে পাঠানো শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে ভিডিও, ছবি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংযুক্ত করা হয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যারা জঙ্গিদের দমন করে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ভূমিকা রাখে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে বিএনপি। বিদেশিদের কাছে তারা নিজ দেশের সম্মানহানি করছে। এগুলো আমরা নির্বাচন ভণ্ডুল করার অপকৌশল হিসেবে দেখছি।’
যে অভিযোগগুলো পাঠানো হয়েছে : গত ৮ জুন লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে পাবনায় বিদ্যুৎ অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের হামলা, পুলিশের নির্লিপ্ততা বিএনপির অভিযোগে স্থান পেয়েছে। এর জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল), পুলিশ ও ডিবির তিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় তিন নেতাকে অভিযুক্ত করা হয় চিঠিতে। এই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সকালে বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়।
জানতে চাইলে অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) হাসিবুল বেনজির। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের ভূমিকার কারণেই ওই দিন সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
৯ জুন যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্নার মুক্তির দাবিতে কুমিল্লা জেলা যুবদলের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ হামলা করে বলে অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে ১৪ পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) কোতোয়ালি থানার ওসি আছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) খন্দকার আশফাকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি ওই দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন না। পরে বিষয়টি জেনেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ করা হয় তা হবে অসত্য ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা সেদিন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেশাদারির সঙ্গে পালন করেছে। এতে পুলিশের কোনো অনিয়ম ছিল না।
১৪ জুন চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশ শেষে মিরসরাইয়ে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে ছাত্রদলকর্মী নাদিয়া নুসরাতকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং মধ্যরাতে পুরনো মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় জড়িতদের নামও পাঠানো হয়েছে দূতাবাসগুলোতে। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছয়জন এবং জোরারগঞ্জ থানার ওসিসহ দুই পুলিশ সদস্যের নাম দেওয়া হয়েছে।
জোরারগঞ্জ থানার ওসি জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না।
নুসরাতের ঘটনার প্রতিবাদে ১৮ জুন মিরসরাইয়ে ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ ২৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়। মামলায় তাদের কাছ থেকে একটি রকেট লঞ্চার উদ্ধার দেখানো হয়। এই ঘটনায় মিরসরাই থানার ওসি ও একজন উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় বিএনপি।
১৯ জুন বগুড়ায় তারুণ্যের সমাবেশে অংশ নিতে নওগাঁ থেকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা রওনা হলে দুপচাঁচিয়া উপজেলায় পুলিশ বাধা দেয়। এ ঘটনায় দুপচাঁচিয়া থানার ওসি, ওসি (তদন্ত) ও তিন উপপরিদর্শকের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, সমাবেশে যেতে বাধা দেওয়ার এই ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। কারণ এতে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
২৩ জুন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা ও পৌর বিএনপি আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনাও দূতাবাসগুলোর নজরে আনে বিএনপি। বলা হয়, বোয়ালমারী থানার ওসির নেতৃত্বে আরো পাঁচ পুলিশ সদস্য লাঠিপেটা করে সমাবেশ ভণ্ডুল করে।
বিদেশি দূতাবাসগুলোতে কেন এই চিঠি দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবী এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজ। কোনো দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার না থাকলে অন্য দেশগুলো তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অন্য দেশগুলো জানতে চাইলে আমরা তাদের জানাই। এটা তারই অংশ।’