আমার বাসায় কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না’— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘পানি জাহাঙ্গীর’।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময় জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন ‘সুধা সদনের’ ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। সে সময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য বাসা থেকে যে খাবার পানি নেওয়া হতো জাহাঙ্গীর সেই কাজটিই করতেন। এজন্যই তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীর এলাকায় নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। একই পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময় তদবির করে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন নোয়াখালী ও রাজধানী ঢাকায়। সঙ্গে রাখেন লাইসেন্স করা পিস্তল।
কোটি কোটি টাকা কামানোর পর রাজনীতিতে নেমেছেন জাহাঙ্গীর। এরপর বনে যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তিনি নোয়াখালীতে বিপুল অর্থও খরচ করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশাল বহর নিয়ে তিনি সভা-সমাবেশ করতেন। এসব সভা-সমাবেশের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে— দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে প্রশাসন দিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহিমের অনুসারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। ইব্রাহিম বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করলে; প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে গত ২৩ ডিসেম্বর একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘নিজেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে নিকটস্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিন।’
সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীর নোয়াখালী ও ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। স্ত্রীর নামে মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে গড়ে তুলেছেন আট তলা একটি বাড়ি। ঢাকার ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে কিনেছেন আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি আলিশান ফ্ল্যাট। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার। ঢাকার মিরপুরে একটি সাত তলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর উল্লেখ করেছেন, কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর তার আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে আয় ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানিয়েছেন।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকা ছিল। ডিপিএস ছিল পৌনে ৩ লাখ টাকা, এফিডিআর ছিল সোয়া ১ কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন জাহাঙ্গীর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে অবশ্য গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন জাহাঙ্গীর। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কি কারও নাম বলেছেন? তিনি ড্রাইভারের (সৈয়দ আবেদ আলী) কথা বলতে গিয়ে এ কথা বলেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী তো পিয়ন বলেছেন। সে সময় দুজন পিয়ন চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এর মধ্যে একজন আপনি, আরেকজন আবদুল মান্নান। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সেই পিয়ন আপনি। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি এটা জানি না। আমি কইতে পারব না।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না না, আমি তো শুনি নাই। এইমাত্র আপনার কাছে শুনলাম।’
সবাই তো আপনার নাম বলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কেমনে কমু। এত কিছু জানি না। আপনের কাছে প্রথম জানলাম।’