মো. মাহমুদুল হক মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন পাঁচ বছর আগে। তার বাবা নুরুল হক ও মা ছেহের বেগম। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা এ ব্যক্তি কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক তরুণীকে বিয়ে করে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। দুই বছরের মাথায় তাদের ঘরে আসে একটি কন্যাসন্তান। এরই মধ্যে মাহমুদুল সৌদি আরবে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট। খুঁজে বের করেন বাদশা নামে এক দালালকে। ওই দালাল তার জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। এজন্য তাকে দিতে হয়েছে অন্তত ১৫ লাখ টাকা। দুই মাসের মাথায় মাহমুদুলের হাতে চলে আসে বাংলাদেশের এনআইডি কার্ড। যার নম্বর ২২১২৬৬০০১৪৮০। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার সদরের পূর্ব কুতুবদিয়াপাড়া। পরে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে তিনি চলে যান সৌদি আরব।
একই এলাকার ঠিকানা দিয়ে দালাল চক্র মোহাম্মদ রাসেল নামে আরেক রোহিঙ্গার এনআইডি কার্ড (২২১২৬৬০০০৫৩২) তৈরি করেন। এনআইডিতে রাসেলের বাবার নাম জাফর আলম ও মা খতিজা উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্মসনদ, এনআইডি তৈরি করেছে। তাদের কেউ কেউ পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে।
দেশ রূপান্তরে অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ সদস্য, নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মাঠপর্যায়ের দালাল চক্র জড়িত। এর জন্য ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। ১২টি স্তরে এই অর্থ ভাগাভাগি হয়।
তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে জালিয়াতি করে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের এনআইডি পেয়েছে। অর্থাৎ ৪০ ভাগের মতো রোহিঙ্গার হাতেই এখন এনআইডি রয়েছে। আর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরেছে এই চক্র। সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কয়েকটি স্থানে সরেজমিনে গিয়েও এসব তথ্যের সত্যতা মিলেছে। এই প্রতিবেদক কয়েকজন দালাল এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি ও পাসপোর্ট করিয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কীভাবে এসব অপকর্ম করেছেন তার ফিরিস্তিও দিয়েছেন তারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের রাখা হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে।
রোহিঙ্গারা জানায়, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ভিন্ন কোনো দেশে চলে গেছে। কেউ আবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করছে।
যাদের হাতে এনআইডি ও পাসপোর্ট : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছর ১৬ অক্টোবর জন্মসনদ, কক্সবাজার পৌরসভার জাতীয়তা সনদ ও প্রত্যয়নপত্রসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের কাগজপত্র নিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করতে কক্সবাজার আঞ্চলিক অফিসে যান মো. সুপাইত নামে এক রোহিঙ্গা যুবক। বাংলাদেশি এক বৃদ্ধ নারীকে নিজের নানি পরিচয় দিয়ে সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু কথাবার্তা সন্দেহজনক ও আঙুলের ছাপে অসংগতি দেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিকভাবে সুপাইতকে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করে তাকে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া কক্সবাজার পৌরসভার কাউন্সিলর মিজানুর রহমান মিজানকে তলব করে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় কাউন্সিলর মিজান পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে তাদের নিয়ে আসেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা কাউন্সিলর মিজান।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রত্যয়নপত্রে আমার সিল ও স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। ওই নারীকে আমি বকা দিয়েছি। আর সুপাইতকে আমি চিনি না। তাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
মো. ইয়াকুব নামে আরেক রোহিঙ্গা পেয়ে গেছেন বাংলাদেশি এনআইডি ও ই-পাসপোর্ট। তিনি আরও আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মৌলবি আবু সালেহর আত্মীয়। তার সহযোগিতায় কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী আরেক পুরনো রোহিঙ্গা আমির হাকিমকে বাবা সাজিয়ে চলতি বছর ২০ জুলাই এনআইডি নিয়েছেন ইয়াকুব। এই আমির হাকিম প্রবাসী।
গত বছর ১৭ ডিসেম্বর ইয়াকুব নিজেকে সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছনখোলা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা উল্লেখ করে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। সেই পাসপোর্ট পেতে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর তাকে রোহিঙ্গা নন বলে প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দেন পিএমখালী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। ইয়াকুবের বাবার নাম আমির হাকিম ও মায়ের নাম ছলিমা খাতুন। এনআইডি নম্বর ৩৭৫৬১০৭২৫০। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে আমির হাকিমের বাড়ি, পাহাড়তলী কক্সবাজার। পাসপোর্ট নম্বর এ০৬১৯২৭২৮। পাসপোর্ট প্রদানের তারিখ ১৭-১২-২০২২। মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১৬-১২-২০৩২।
সনদ দেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো রোহিঙ্গাকে সনদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার কাছে স্থানীয় লোকজন এসে জন্মসনদ নিয়ে যান। যদি কেউ পেয়ে থাকেন তাহলে সে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।’
পিএমখালী ইউপির সংরক্ষিত সদস্য আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘শুধু ইয়াকুব নয়, তার পুরো পরিবারই রোহিঙ্গা। বিষয়টা স্থানীয় বাসিন্দারাও জানেন। কিন্তু কীভাবে তিনি পাসপোর্ট পেলেন তা ভেবে আমিও অবাক হয়েছি।’
অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার এনডিআই পাওয়ার তথ্য জানা গেছে। তাদের মধ্যে আছেন মোছাম্মৎ উম্মে কুলসুম (এনআইডি নম্বর-২২১২৬৬০০০১৯), বাবার নাম মোহাম্মদ আলী ও মায়ের নাম নাছিমা বেগম। ঠিকানা কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। একই এলাকার ঠিকানায় মোহাম্মদ জাকারিয়া (২২১২৬৬০০১৬০১)। বাবার নাম মোহাম্মদ আব্বাস ও মায়ের নাম গোলবাহার। নুর হোসেন (২২১২৬৬৪৫৬৭১৫)। বাবার নাম হাফেজ আহমদ ও মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। আবু তাহের (২২১২৬৬০০১৭৯৫)। বাবার নাম লাল মোহাম্মদ ও মায়ের নাম মাইয়েশা বেগম। তার ঠিকানা-ফদনার ডেইল, কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। কমরু আক্তার (২২১২৬৬০০১৭১৫)। স্বামীর নাম জাহাঙ্গীর আলম ও মায়ের নাম ছকিনা বেগম। ঠিকানা কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। আলমগীর (২২১২৬৬০০০৮৩৫)। বাবার নাম মো. হাসান ও মায়ের নাম হোসনে আরা। ঠিকানা পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। সিরাজুল ইসলাম (২২১২৬৬০০০৩৩০)। বাবার নাম আমির হামজা ও মায়ের নাম গোল বানু। ঠিকানা ৮ নম্বর গলি কক্সবাজার। মো. ইসমাইল (২২১২৬৬৫১৪১৬৭)। বাবার নাম শামশুল আলম ও মায়ের নাম মোস্তফা খাতুন। ঠিকানা ফদনার ডেইল, কক্সবাজার। মিজান (২২১২৬৬৫১৭১৩৪)। বাবার নাম কবির আহমদ ও মায়ের নাম হাজেরা খাতুন। ঠিকানা পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। আবদুর রাজ্জাক (২২১২৬৬৪৫৫৮৪৭)। বাবার নাম আবদুস শুক্কুর ও মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। ঠিকানা সমিতিপাড়া, কক্সবাজার। রশিদ আহমদ (২২১২৬৬০০১২৯০)। বাবার নাম আবদুল হাকিম ও মায়ের নাম আনোয়ারা। ঠিকানা মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। জিয়া রহমান (২২১২৬৬০০১৭৩৯)। বাবার নাম জাফর আলম ও মায়ের নাম খতিজা বেগম। ঠিকানা মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। আজিজুল হক (২২১২৬৬০০০৫৮৩)। বাবার নাম নুরুল হক ও মায়ের নাম ছেহের বেগম। ঠিকানা পূর্ব কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। আবু বক্কর ছিদ্দিক (২২১২৬৬৫১৫৮৬১)। বাবার নাম আলী আহমদ ও মায়ের নাম হাছিনা বেগম। ঠিকানা কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার। মাতবর আলী (৪৬৫৮৬০০০২)। বাবার নাম নজির হোসেন ও মায়ের নাম জাহান আরা। ঠিকানা পশ্চিম পাহাড়তলী, ৭ নম্বর ওয়ার্ড, কক্সবাজার। নুর মোহাম্মদ (২২১২৮৬৩৭৫৫৫)। বাবার নাম মৃত মো. কাশেম। ঠিকানা ইসলামপুর, পাহাড়তলী, কক্সবাজার। ইয়ার মোহাম্মদ (২২১২৮৬৩৭৩৫৫৬)। বাবার নাম মো. কাশেম। ঠিকানা ইসলামপুর, পাহাড়তলী, কক্সবাজার। দিল মোহাম্মদ (২২১২৮৬৩৭৩৫৫৭)। বাবার নাম মো. কাশেম। ঠিকানা ইসলামপুর, পাহাড়তলী, কক্সবাজার। নুরুল বশর (২২১২৮৬৩৭৩৫৬৯)। বাবার নাম কাদের হোসেন। ঠিকানা ইসলামপুর, পাহাড়তলী, কক্সবাজার। জাকির হোসেন (৯১৪২৯৬২৫৮৯)। বাবার নাম আমিরুজ্জামান ও মায়ের নাম কালা বিবি। ঠিকানা দক্ষিণ পাতলী, খরুলিয়া, কক্সবাজার। ছৈয়দ আলম (৫০৮৯৪০৮০১৬)। বাবার নাম উলা মিয়া ও মায়ের নাম ছেমন বাহার। ঠিকানা নাইক্ষ্যংখালী হ্ণীলা, টেকনাফ। ফাতেমা বেগম (২৮৩৯৪০৭৮১০)। বাবার নাম আবুল মঞ্জুর ও মায়ের নাম জোন বিবি। ঠিকানা নাইক্ষ্যংছড়ি, দক্ষিণ হ্ণীলা, কক্সবাজার।
তাদের মধ্যে জাকির ও ফাতেমার এনআইডির সত্যতা যাচাই করে স্বাক্ষর করেছেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বেল্লাল উদ্দিন। এ বিষয়ে বেল্লাল উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। জন্মসনদ, এনআইডি নিতে কোনো রোহিঙ্গাকে সহায়তা করার প্রশ্নই আসে না। কেউ আমার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।’
সেগুফা ইয়াছমিন (২০০৪২২১৯০৩১০৬৬৬১)। বাবার নাম কামাল হোসেন ও মায়ের নাম আমেনা খাতুন। ঠিকানা ৩০৪ উলাতাময়ী (হামজার ছড়া) হ্নীলা বাজার, টেকনাফ। জন্মনিবন্ধনে স্বাক্ষর করেন ২ নম্বর হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (৬ নম্বর ওয়ার্ড) আবুল হোছন। উম্মে সাবিহা। তার জন্ম ২০২৩ সালের ৫ মে। তাকে জন্মসনদ দেওয়া হয়েছে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ৬৮২ নাইক্ষ্যংছড়ি, হ্ণীলা। বাবার নাম মোহাম্মদ কাইয়ুম ও মা সেগুফা ইয়াছমিন। তারাও একই ইউনিয়ন থেকে জন্মসনদ নিয়ে এনআইডি তৈরি করেছেন। মোহাম্মদ আইয়ুব নামে আরেক রোহিঙ্গা একই ইউপি থেকে জন্মসদন (২০০১২২১৯০৩১০০৩৫৯৭) নিয়েছেন।
চল্লিশ দালাল : সরেজমিনে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পেতে টাকার বিনিময়ে সহযোগিতা করেন উখিয়ার পালংখালীর জহির, মনখালীর শামসুল ইসলাম, কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়ার নাছির, হিমছড়ির বড়ছড়ার জসিমউদ্দিন, ঘোনাপাড়ার শাহাবুদ্দিন জনি, রুমালিয়ারছড়ার জাহাঙ্গীর, মসজিদ মার্কেটের নিচতলার মেহেদী, কালুর দোকানের বশির ও হারুনসহ অন্তত ৪০ জন। তাদের নিয়মিত বিচরণক্ষেত্র পাসপোর্ট অফিস, আদালত চত্বর, পৌরসভা গেট ও জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের আশপাশের এলাকা। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই শহরে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছেন প্রশাসনের নাকের ডগায়।
দালাল চক্রের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের জড়িত থাকারও তথ্য মিলেছে।
এ দালালদের মধ্যে শাহাবুদ্দিন জনির সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তবে রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলতে না পারায় তিনি ঝামেলা আঁচ করে পিছিয়ে যান। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তি জনির সঙ্গে কথা বলেন। জনি জানান, রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি করে দিতে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এই টাকার ভাগ পান জনপ্রতিনিধি, পাসপোর্ট, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের লোকেরা। সব টাকা প্রথমে দালাল নেন। তার কাছ থেকে ভাগ হয়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ চলে যায় জিম্মাদার, কাউন্সিলর ও তার ব্যক্তিগত সচিব (পিএস), ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট গ্রহণকারী নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনদাতা, রোহিঙ্গা নয় এমন প্রত্যয়নপত্র ও ভূমি সনদের প্রত্যয়নপত্র যারা দেন তাদের কাছে।
রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিবেদককে অবহিত করেছেন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শহরের ঘোনারপাড়ায় বসবাসকারী এক দালাল। আবদুর রহমান নামে পরিচয় দিয়ে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়া স্থানীয়দের চেয়ে সহজ। কারণ রোহিঙ্গারা চুক্তি করেই পাসপোর্ট করে। ধরা যাক, কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট করতে এসেছে। সে যখন কোনো দালালের মাধ্যমে অনলাইনে ফরম পূরণ করবে সঙ্গে সঙ্গে ফরমটির ছবি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে চলে যাবে। সেই পাসপোর্ট যাচাই করবেন কোন কর্মকর্তা খবর রাখবে দালাল চক্রটি। সেই কর্মকর্তাকেও টাকা দেওয়া হয়। কক্সবাজারে পাসপোর্ট পেতে সমস্যা হলে বান্দরবান বা চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিস থেকে নেওয়া হয়।
এত টাকা রোহিঙ্গারা কোথায় পায় এমন প্রশ্নের জবাবে একটি দালাল চক্রের প্রধান রমজান মিয়া বলেন, যেসব রোহিঙ্গা এনআইডি কিংবা পাসপোর্ট করায় তাদের অধিকাংশই মাদক, অস্ত্র পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িত। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গার স্বজন বিদেশে রয়েছে কিংবা স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অর্থের অভাব হয় না।
প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার হাতে এনআইডি : অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি এনআইডি পাওয়া ঠেকাতে কক্সবাজারের ৯ ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮ উপজেলাসহ আশপাশের ৩১টি উপজেলাকে বিশেষ অঞ্চল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এ অঞ্চলের লোকজনকে ভোটার হতে হলে একটি বিশেষ ফরম পূরণ করতে হয়। এ বিশেষ ফরম যাচাইয়ের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। সেই বিশেষ কমিটির সুপারিশ ছাড়া কাউকে ভোটার করা হয় না। তারপরও রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে এনআইডি ও পাসপোর্ট। রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট করার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের টাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশে থাকা রোহিঙ্গা গোষ্ঠী ও স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যাওয়া পুরনো রোহিঙ্গারা।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৮২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৪১ বছরে যারা এসেছে তাদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা এনআইডি সংগ্রহ করেছে বলে আমরা অনেকটা নিশ্চিত হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে লাখখানেক রোহিঙ্গা রয়েছে যাদের হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। তারা ওইসব দেশের যেসব এলাকায় থাকে সেগুলো বার্মাইয়াপাড়া নামে পরিচিত। আমি নিজে দুবার সৌদি আরবে গিয়ে দেখেছি সেখানকার নাক্কারা, সংবানিয়, গজা এলাকা বার্মাইয়াপাড়া নামে পরিচিত। সেখানকার কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গার কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে।’ তাদের হাতে কী করে পাসপোর্ট গেল এমন প্রশ্নের জবাবে মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা, পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও একটি চিহ্নিত দালাল চক্র বছরের পর বছর এই অপকর্ম করে যাচ্ছে। শুধু পাসপোর্ট অফিসে নয়, এই চক্রটি রোহিঙ্গাদের ভোটার হতেও সহযোগিতা করছে।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয়তার সনদ ও এনআইডি পেয়েছে এমন অনেক রোহিঙ্গাকে আমরা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছি। তাদের এনআইডি বাতিল করতে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে লিখিত আবেদন করেছি। এ পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গার তালিকা জমা দিয়েছি। তবে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কী করেছে, আমরা জানি না।’
রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়া : ‘স্থানীয়’ বনে যাওয়া পুরনো রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় নতুনরা ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কোনো গ্রামে আশ্রয় নেয়। এরপর জন্মনিবন্ধন পেতে দালাল চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। দালালের পরামর্শে ওই গ্রামের কিংবা আশপাশের গ্রামের ভোটার এমন কাউকে টাকার দিয়ে বাবা-মা সাজায়। দালালদের সহায়তায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তারা জন্মনিবন্ধন সনদ নেয়। পরবর্তী ধাপে ভোটার তালিকার বিশেষ ফরমে সাজানো বাবা-মার সব তথ্য ব্যবহার করা হয় এবং আগের জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষর ও সহযোগিতায় বিশেষ কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়। কাজ বাকি থাকে শুধু ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ। এখানেও যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য আগে থেকে ম্যানেজ করা হয় নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ১০-১২ লাখ টাকা দিতে হয় রোহিঙ্গাদের।
পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘৫ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে এ ধরনের পাসপোর্ট তারা করিয়ে দেন। একেবারে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত যতগুলো ধাপ রয়েছে, সব ধাপে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রত্যেকের কাছেই টাকার ভাগ চলে যায় বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার ৭১টি ইউনিয়নেই কমবেশি রোহিঙ্গা বসবাস করে। তবে কক্সবাজার পৌরসভা, ঈদগাঁও, ঝিলংজা, পিএমখালী, উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে স্থায়ীভাবে বাস করা রোহিঙ্গাদের হার বেশি।
এ বিষয়ে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহরের পাহাড়তলী, বৃহত্তর ঘোনারপাড়া, বাস টার্মিনাল, কলাতলী, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়া, নুনিয়ারছড়া ও পেশকার পাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাদের অনেকে এনআইডিও নিয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় তাদের শনাক্তের কাজ চলছে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থা : এই চক্রের দালালরা এখন জাল পাস বিক্রি করছে বলে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা গেছে। সম্প্রতি উখিয়ার অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা অবাধে চলাচল করছে। যে যার মতো ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। ক্যাম্প এলাকা থেকে উখিয়ার সোনারপাড়া হয়ে কক্সবাজার সদরে আসতে উখিয়া কলেজগেট, মেরিন ড্রাইভ সংযোগ সড়ক, রেজুখালী এবং হিমছড়িতে পুলিশ চেকপোস্ট থাকলেও চেহারা দেখেই অধিকাংশ যানবাহন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। একই অবস্থা কোর্টবাজার-কক্সবাজার লিংক রোডেও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোটার আইডি চাওয়া হয়। কেউ দেখাতে পারে, আবার কেউ পারে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেশি-বিদেশি নাগরিক, এনজিওকর্মীসহ যেকোনো ব্যক্তির প্রবেশের ক্ষেত্রে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) অনুমতি বাধ্যতামূলক হলেও বাধা না থাকায় এ প্রতিবেদকের মতো যে কেউই নির্বিঘেœ ক্যাম্পে ঢুকে পড়ছে।
বালুখালী-২ ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা অবাধে বাইরে আসা-যাওয়া করছে। ক্যাম্পের ভেতরে দোকানপাটে চলছে কেনাবেচা। ‘জি’ ব্লকের একটি ঘরে দেখা যায়, নানান আসবাবপত্রে ঘরটি সাজানো। ঘরে একটি গ্যাস সিলিন্ডারও চোখে পড়ে। সন্তানদের নিয়ে ‘সুখেই আছেন’ বলে জানান সেখানকার বাসিন্দা আজহার হোসেন মাঝি। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবারের সবার এনআইডি করে দিতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন কবির নামে এক দালাল। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছি। কিন্তু কবির আরও বেশি চান।’ এত টাকা কোথায় পাবেন জানতে চাইলে তিনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে আমার ব্যবসা আছে।’ কী ব্যবসা জানতে চাইলে আজহার বলেন, ‘বার্মাইরা যা করে এখানেও তা চলে।’ এনআইডি করতে পারলে ক্যাম্প ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাবেন বলে জানান তিনি।
রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পাস দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রোহিঙ্গারা যদি সত্যি সত্যি সার্টিফিকেট পেয়ে থাকে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্কুলগুলোতেও সতর্কতা আছে।’
আবেদন তদন্ত করে না পুলিশ : জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গারা জন্মসনদ সংগ্রহ করে এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি করে ফেলছে তা সত্য। এসব কাজে আমাদের কতিপয় সদস্য সহায়তা করে থাকে। গত বছর ২৭ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক সাজিয়ে জন্মনিবন্ধন, ভোটার আইডি ও পাসপোর্ট করতে সহযোগিতা করায় চট্টগ্রাম সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানকে আসামি করে একটি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই মামলায় অ্যাডভোকেট আবুল কালামকেও (নোটারি পাবলিক) আসামি করা হয়। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ পাঁচ পুলিশ সদস্য, সাত পৌর কাউন্সিলর, দুই ইউপি চেয়ারম্যান ও দুই সচিব ও এক আইনজীবীসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জন্মসদন, এনআইডি ও পাসপোর্ট করতে রোহিঙ্গাদের যারা সহায়তা করছে তাদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যারা এসব পেয়েছেন সেগুলো বাতিল করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি কর্মকা- কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে।’
উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেভাবে এই দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে, তাতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত।’
কক্সবাজার জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা এসএম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি। রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে এমন লিখিত অভিযোগ পেয়ে ব্যবস্থা নিতে কমিশনে পাঠিয়েছি।’
কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, ‘বেশিদিন হয়নি আমি এখানে এসেছি। এর মধ্যেও কয়েকজনের কথাবার্তা সন্দেহ হওয়ায় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট গ্রহণ করিনি।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটার হওয়ার প্রক্রিয়ায় পুলিশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পাসপোর্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আছে, কিন্তু তদন্তে গরমিল পাওয়া গেছে, এরকম অনেকের ক্ষেত্রে আমরা নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছি। সুত্র: দেশ রুপান্তর