তোফায়েল আহমদ
দীর্ঘ ৬১ বছর ধরে একজন কট্টর আওয়ামী লীগার হিসাবেই খ্যাতি নিয়ে দিন যাপন করছেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং গ্রামের বাদশা মিয়া চৌধুরী। আজ রবিবার ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭০ তম প্রতিষ্টা বার্ষিকী। এমন দিনে বাদশা মিয়া চৌধুরী জীবনের ৬১ বছরের আওয়ামী লীগ রাজনীতির স্মৃতি চারণ করে বলেন-‘আওয়ামী লীগ করা এক সময় সাংঘাতিক অন্যায় কাজ ছিল। কি সমাজ কি এলাকা এমনকি নিজ পরিবারে পর্যন্তও এ দলটির কর্মী সমর্থক ছিল যেন একজন অপয়া মানুষ। অথচ এমন রাজনৈতিক দলটিই ধীরে ধীরে দিয়েছে একটি জাতির ভাষা থেকে শুরু করে একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকা। এমনকি এই রাজনৈতিক দলটিই দিতে পেরেছে একজন জাতির জনক পর্যন্ত।’
তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগটক।। গ্রাম-গঞ্জে অধিক পরিচিতি বাদশা মিয়া চেয়ারম্যান। তবে লোকে বলে ’মুজিব কোটের বাদশা মিয়া’। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের যোদ্ধা তিনি। ছয় দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় ভুমিকায় ছিলেন এই লড়াকু মানুষটি।
বাদশা মিয়া চৌধুরী বলেন, আমি এবং উখিয়ার প্রয়াত আলী আহমদ বি,কম অত্যন্ত গোপনে ১৯৫৮ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলাম। সেই সময় কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মহিউদ্দিন মিয়া ছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সেদিনের আওয়ামী লীগ সমর্থক বা কর্মী হওয়াটাই ছিল অত্যন্ত ‘অপরাধের কাজ’।
সবচেয়ে বেশী সমস্যার মুখে পড়তে হত ধর্মীয় গোঁড়ামীর। মুসলিম লীগার সহ ধর্মীয় রাজনীতিবিদগণ নানা ভাবে ফতোয়া দিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘ধর্ম বিরোধী রাজনৈতিক দল’ বলে বলে বেড়াত। এসব কারনে আওয়ামী লীগে আমরা যোগ দিয়ে এক প্রকার কোনঠাসা হয়ে থাকতাম। তিনি বলেন, আজ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলটি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। আওয়ামী লীগই বাঙ্গালী জাতিকে একটি লাল-সবুজের পতাকা উপহার দিয়েছে।
আওয়ামী লীগার বাদশা মিয়া চৌধুরীকে নিয়ে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী গতকাল বলেন-‘উখিয়া-টেকনাফে আমার জানামতে সবচেয়ে প্রবীণ আওয়ামী লীগার হিসাবে রয়েছেন বাদশা মিয়া চৌধুরী। তিনি একজন প্রকৃত ভাল মানুষ। আওয়ামী লীগের একজন খাঁটি তৃণমূল নেতা।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পর থেকেই তার গায়ে ‘মুজিব কোট’। জাতির জনকের প্রতীক সেই ‘মুজিব কোট’ দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরেই গায়ে তার। কি গরম, কি শীত-বর্ষা একই রকম তার কাছে। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে একদিনের জন্যও তিনি মুজিব কোট খুলেননি। বাদশা মিয়া চৌধুরী বলেন-‘মুজিব কোট আমার কাছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক, আওয়ামী লীগের প্রতীক, বঙ্গবন্ধুর প্রতীক, জাতির জনকের আদর্শের প্রতীক।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে মুজিব কোট গায়ে দিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই প্রতীক আমি খুলতে পারিনা। অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে বাদশা মিয়া চৌধুরী বলেন-‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের সেই বিয়োগান্তুক ঘটনার পর অনেকেই ভয়ে মুজিব কোট খুলে রেখে পালিয়েছিলেন। আর আমি তখনই থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য গায়ে চড়িয়েছি মুজিব কোট । মৃত্যুর আগ পর্যন্তই আমার গায়ে মুজিব কোট থাকবে।’
সার্টিফিকেট অনুযায়ি বয়স তার ৮১ বছর। তবে প্রকৃত বয়স ছিয়াশি বছর। এখনো চশমা ছাড়াই পত্রিকা পড়েন। প্রতিদিনের মেনু হচ্ছে সকালে পানি ভাতের সাথে পুড়া মরিচ। তিনি জানান-‘পানি ভাতের কারনেই আমি ৮৮ বছর ধরে একজন তরুণই থেকে গেলাম। পানি ভাত আমাকে গ্যাষ্ট্রিক থেকেও মুক্ত রেখেছে। আমার জানা মতে তেমন জটিল রোগে পড়িনি। পানি ভাত আমাকে রেখেছে সদা তরতাজা।’
১৯৫৬ সালে পটিয়ার রাহাত আলী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাদশা মিয়া চৌধুরী পরের বছর থেকেই ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে যান। তিনি ১৯৫৭ সালে নির্বাচিত হন কক্সবাজারের উখিয়ার বৃহত্তর রতœা পালং ইউনিয়নের ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে। আর ১৯৬৪ সালে নির্বাচিত হন উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে। সেই থেকে ৫ বারের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। আজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত গ্রামীণ জনপদের এই মানুষটি একজন ‘খাঁটি তৃণমূলের রাজনীতিক’ হিসাবেই দিন যাপন করে চলেছেন।
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের অনেক কাহিনী তার। কতসব বলা যাবে। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর পিতা নবী চৌধুরীর সাথে ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে কাজ করেছেন একজন একনিষ্ট কর্মী হিসাবে। সেই যে নবী চৌধুরীর সাথে পরিচয়-সেটা কাজে এসেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। নবী চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামে সেই সময় পাকিস্তানীদের একজন বিশ্বস্ত মানুষ।
আবার তিনিই ছিলেন নেপথ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক। নবী চৌধুরীর একটি সিøপই ছিল ‘চলাচল পাশ’। এরকমই একটি সিøপ নিয়ে বাদশা মিয়া চৌধুরী গোপনে কাজ করেছেন দক্ষিন চট্টগ্রাম, বান্দরবান সহ কক্সবাজারের মুক্তিযুদ্ধে। নবী চৌধুরীর সেই একটি চলাচল পাশ নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট অনেক গোপন সংবাদ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।
বাদশা মিয়া চৌধুরী কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় মিয়ানমারের (বর্মা) ঢেকিবুনিয়ায় গিয়েও। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন (অব:) আবদুস সোবহান সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাজ করেছেন।
তিনি দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে কাজ শুরু করেন। এই মুজিব কোট গায়ে দিলে আর পরিচয় দেওয়ার দরকার হয় না। এটাতেই বড় সান্তনা পান তিনি। আবার এই মুজিব কোট নিয়ে বিব্রতও হয়েছেন। প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, একবার তিনি কক্সবাজারের তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) অফিসে একটি জনগুরুত্বসম্পন্ন কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন মুজিব কোট পরিহিত বাদশা মিয়াকে অফিসে প্রবেশ করতে বারণ করা হয়েছিল।
তিনি বালেন-জাতির জনকের এই স্মৃতি বিজড়িত মুজিব কোট নিয়ে যিনি তাকে এসডিও সাহেবের অফিসে ঢুকতে দেননি তিনি হচ্ছেন কুতুবদিয়া দ্বীপের মরহুম জালাল আহমদ চৌধুরী। স্বাধীনতা বিরোধী আল বদর রাজাকার সর্দ্দার এই জালাল আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতা পরবর্তী জাতির জনকের নিকট থেকে ক্ষমা নিয়ে এসেই জাগদল-বিএনপি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিলেন। আর সেই জালাল আহমদ চৌধুরীই তাকে মুজিব কোট পরিহিত অবস্থায় ঢুকতে দেননি এসডিও অফিসে।
মুজিব কোট পরিহিত মুক্তিযোদ্ধা বাদশা মিয়া চৌধুরী দেশ স্বাধীন হবার পর নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তালিকাভুক্তির কোন তদবির করেননি। এ কারনে তিনি তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা নন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কেবল গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে দীক্ষা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির। হাটে-বাজারে আর চা দোকানে প্রতিনিয়ত রাজনীতি করেছেন আওয়ামী লীগ আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে।
অথচ সেই আওয়ামী লীগের কোন কমিটিতেও বাদশা মিয়া চৌধুরীর স্থান হয়নি। নেই তিনি আওয়ামী লীগের বর্তমান কক্সবাজার জেলা বা অন্যান্য কমিটিতেও। আজীবনের একজন আওয়ামী লীগার-যিনি জীবনের ৪৪ বছর ধরে ‘মুজিব কোট’ গায়ে জাতির জনকের আদর্শ ধারণ করে চলেছেন সেই ‘মুজিব কোটের বাদশা মিয়ার’ স্থান হয়নি জাতির জনকের দলের কোন কমিটিতে। আবার তদবির না করায় মুক্তিযুদ্ধের তালিকায়ও নাম নেই তার। এই কি নির্মম পরিহাস ?