বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তার উদ্যোগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অনার্স প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছেন ৭০০ ভর্তিচ্ছু। এই অনন্য দৃষ্টান্তটি স্থাপন করে প্রশংসা ভাসছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা (স্নাতক)। এদিন দুপুর সাড়ে ৩টায় শুরু হওয়ার কথা এই ইউনিটের চতুর্থ ও শেষ শিফটের পরীক্ষা।
এ পরীক্ষায় অংশ নিতে সকাল ৬টায় ‘ধূমকেতু এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ওঠেন ‘সি’ ইউনিটের চতুর্থ শিফটের ৭০০ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। কিন্তু শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে রাজধানী ছাড়তে এ ট্রেনের দেরি হয়।
ভর্তিচ্ছুরা জানান, ট্রেনটি রাজশাহীতে পৌঁছানোর কথা দুপুর ৩টায়। যথাসময়ে ছাড়লে যেটি পৌঁছাতো বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু ভাগ্য এতোই খারাপ, পথিমধ্যে ধূমকেতুর ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। ট্রেনে থাকা শিক্ষার্থীরা তখন ধরেই নিয়েছিলেন, জীবনের মহা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটা হয়তো দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু ‘দ্য রেলওয়ে ম্যান’ অসীম কুমার তালুকদারের আন্তরিকতার কারণে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান তারা।
সেদিন রাতেই রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি পোস্ট দেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার।
তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় ৭০০ ছাত্র-ছাত্রীর ‘ধুমকেতু এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে গিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা। রেল ব্রোকেনের জন্য ধুমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকেই বিলম্বে রওনা হয়। সকাল ১১টায় হিসেব করে দেখা গেল, ট্রেনটি বিকেল ৩টা নাগাদ রাজশাহী পৌঁছাবে।’
ভর্তিচ্ছুরা জানান, তখন থেকেই কাজ শুরু করেন অসীম কুমার। পরীক্ষার্থীদের সময়ের ব্যাপারে চিন্তা করে ধূমকেতু এক্সপ্রেসকে এগিয়ে নিয়ে আসেন অন্য কয়েকটি ট্রেনকে বসিয়ে রেখে। কিন্তু বিধি বাম! লাহেড়ী মোহনপুর স্টেশনে এসে ধূমকেতুর ইঞ্জিন ফেল করে। ফলে ট্রেনটির চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
এরপর শরৎনগরে থাকা ‘চিলাহাটি এক্সপ্রেস’ ট্রেনটির ইঞ্জিন কেটে এনে ধূমকেতু এক্সপ্রেসে প্রতিস্থাপন করা হয়। আবার চালু হয় ট্রেনটি। এতো প্রচেষ্টার পরও দেখা যায়, ট্রেনটি বিকেল ৪টায় রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছাবে। কিন্তু ততক্ষণে পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।
উপায়ান্তর না দেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারকে পরীক্ষার সময় পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান অসীম। আন্তরিক যোগাযোগ রাখছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। ফোন করে জেনে নিচ্ছেন ট্রেনের খবর। সময় বাঁচাতে আড়ানি স্টেশনের স্টপেজে ট্রেন না থামানোর নিদের্শ দেন অসীম কুমার।
পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেনটি পৌঁছে বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে। ভিসির কাছে ‘লেট এন্ট্রি’র বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন অসীম। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলেও তাই শুধুমাত্র তাদের জন্য হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল আরও ২০ মিনিট।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, একটা ঝুঁকি নিয়েই ফেললাম। ওরা আমাদের সন্তান। আর গত বছর আমার সন্তানের ভর্তি পরীক্ষার সময় দৌড়াদৌড়ির অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমার পুরো টিম দায়িত্ববোধ নিয়ে আগ্রহ সহকারে এই শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেছে। উপাচার্য নিজেও অনেক সহানুভূতিশীল হয়ে আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও সহায়তা করেছে।
ভর্তি পরীক্ষার শেষের দিন বুধবার প্রেস বিফ্রিংয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, দুর্ভোগ বলে কয়ে আসে না। ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ায় ঠিক সময়ে ট্রেনটি আসতে পারেনি। ওই ট্রেনে মঙ্গলবারের ‘সি’ ইউনিটের চতুর্থ শিফটের ১২৫ জনের মতো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট পর পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে মানবিক বিবেচনায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় বলে জানান তিনি।
খবরটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। প্রশংসার স্তুতি বা বাহবার পাহাড় জমে অসীম কুমার তালুকদারের নামে। তাকে বা তার এই গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের দাবি জানান অনেক নেটিজেন।
একজন ফেসবুকে লিখেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন টেস্ট ছিল। ঢাকা থেকে আসা একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। থ্যাংকফুলি পশ্চিমাঞ্চল ট্রেনের মহাব্যবস্থাপক সেটা মনিটর করেছেন। নিজে রাবি’র ভিসির সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষায় লেট এন্ট্রির ব্যবস্থা করেছেন। অন্য ট্রেনের ইঞ্জিন ওই নষ্ট ট্রেনে সেট করে দ্রুত রাজশাহী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন।
তিনি লিখেন, এতো কষ্ট না করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও কারও কিছু করার ছিল না। একটু সহমর্মিতা, একটু আন্তরিকতা দেখিয়েছেন বলে অন্তত ৭০০ শিক্ষার্থীকে চোখের পানি ফেলতে হয়নি। তার নাম অসীম কুমার তালুকদার।
পাঠকের মতামত