ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৭৭ জন তরুণ-যুবক কয়েক বছর ধরে ‘নিখোঁজ’ আছে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ওই তরুণদের বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। এরই মধ্যে পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহ করা হয়েছে ১০ জনের। পুলিশ ও র্যাবের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, যেসব পরিবারের সদস্য দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ আছে সেসব পরিবারকে তাদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে হবে। কোনো লুকোচুরির আশ্রয় নিলে উল্টো পরিবারের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
জানা যায়, ‘নিখোঁজ’ হওয়া কোনো কোনো তরুণের পরিবার এ বিষয়ে পুলিশকে যথাসময়ে জানালেও বেশির ভাগ পরিবারই বিষয়টি গোপন রাখে। যেমন গুলশানের রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে রোহান ইবনে ইমতিয়াজসহ দুজন দীর্ঘ সময় নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের পরিবার থানায় জিডিও করেছিল। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঘটনায় নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারী আবীর রহমান কয়েক মাস আগে নিখোঁজ হলেও জিডি করা হয়েছে হামলার আগের দিন।
এদিকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে জঙ্গি তত্পরতায় যুক্ত হয়ে প্রাণ হারানো কারো কারো পরিবার সন্তানের লাশ গ্রহণ করতেও রাজি হচ্ছে না। শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গি আবীর রহমানের ভাই আশিকুর রহমান গতকাল শনিবার দুপুরে বাসার ইন্টারকমে বলেন, ‘আমরা লজ্জিত-দুঃখিত, দেশবাসীসহ সারা বিশ্বের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সে আমাদের কেউ না। আমরা তাকে ভাই হিসেবে মানছি না। তার লাশ আনারও কোনো অধিকার নেই আমাদের। আমরা তার লাশ চাই না। আমাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে সে। যারা তার মগজধোলাই দিয়ে জঙ্গি পথে নিয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে সরকারকে।’ নিরাপত্তাজনিত কড়াকড়ির কারণে আবীরদের বাসার ভেতরে ঢোকা যায়নি। এদিকে একই রকম আকুতি জানিয়েছেন গুলশানের রেস্তোরাঁয় নিহত নিবরাস ইসলামের মা-বাবা। জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁরা একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি কালের কণ্ঠে এসেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে অন্তত ৭৭ জন তরুণ-যুবক নিখোঁজ হয়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গি তত্পরতায় লিপ্ত হতে পারে। তাদের নিয়ে উত্কণ্ঠায় আছে পরিবার। ওই তরুণদের সন্ধান পেতে এরই মধ্যে নানা তত্পরতা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজ ৭৭ জনের মধ্যে ১০ জনের পাসপোর্ট নম্বরসহ প্রোফাইল তৈরি করেছে পুলিশ। ওই ১০ জনের পরিবারও পুলিশ-র্যাবের সহায়তা চেয়েছে। তাঁদের উদ্ধার করতে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে। যাঁদের প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে তাঁরা হলেন বাড্ডার জুনায়েদ খান (পাসপোর্ট নম্বর এ এফ ৭৪৯৩৩৭৮), তেজগাঁওয়ের বাসারুজ্জামান (পাসপোর্ট নম্বর এ এল ৭৩৮৪৯৮৭), গুলশানের আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম (পাসপোর্ট নম্বর এ এফ ৫২৫৮৪৯৬২৫), ধানমণ্ডির জুবায়েদুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর ই১০৪৭৭১৯), পুরান ঢাকার ইব্রাহিম হাসান খান (পাসপোর্ট নম্বর এ এফ ৭৪৯৩৩৭৮); সিলেটের তামিম আহম্মেদ চৌধুরী (পাসপোর্ট নম্বর এল ০৬৩৩৪৭৮), মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি (পাসপোর্ট নম্বর টি কে ৪০৯৯৮৬০), জুল্লন শিকদার (পাসপোর্ট নম্বর বি ই ০৯৪৯১৭২); চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ আনসারী এবং লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন (পাসপোর্ট নম্বর এফ ০৫৮৫৫৬৮)।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নিখোঁজ সবাইকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে যারা নিখোজ হয়েছে তাদের বেশির ভাগই সচ্ছল পরিবারের সন্তান বলে আমরা জানতে পেরেছি। নিখোঁজ হওয়ার পর অনেকের পরিবার থানায় জিডি করতে আসেনি।’ তিনি জানান, কিশোরগঞ্জের ঘটনায় আটক আবু মোকাদ্দেল ওরফে শরিফুল ইসলাম ওরফে সোহান আড়াই বছর আগে থেকে নিখোঁজ ছিল বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। এরই মধ্যে তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হিসাব রেখে স্থানীয় থানায় তা অবহিত করতে কয়েক দিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, যেসব তরুণ নিখোঁজ হয়ে আছে তাদের উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। গুলশান ও কিশোরগঞ্জে হামলায় যারা জড়িত তারা সচ্ছল পরিবারের সন্তান। নিহত জঙ্গিরা জেএমবির সঙ্গে জড়িত। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানান। সমাজের প্রত্যেক মা-বাবার উচিত সন্তানরা কোথায় যায়, কী করে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করা।’
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিখোঁজ যুবকদের খোঁজে বের করা হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবারের পক্ষ থেকেও সহায়তা করতে হবে। যেসব পরিবারের এখনো সন্তান নিখোঁজ আছে তা আমাদের জানান।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘নিখোঁজ যুবকদের উদ্ধার করতে পুলিশকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব পরিবার নিখোঁজের ব্যাপারে থানায় জিডি করেছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। গুলশান ও কিশোরগঞ্জে হামলা চালাতে গিয়ে যেসব জঙ্গি মারা গেছে তাদের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের পরিবারেরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কোনো ঘটনায় যদি পরিবারের গাফিলতি থাকে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে পরিবারের অভিযোগ পুলিশ আমলে নেয়নি কেন জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি লক্ষ্য করবেন, শনাক্ত জঙ্গিরা সকলেই পুলিশের তালিকাভুক্ত। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। পুলিশ তাদের খুঁজছিল। সুতরাং তরুণদের নিখোঁজের বিষয়ে মা-বাবার অভিযোগ পুলিশের আমলে না নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, যেখানে পুলিশ তালিকাভুক্ত জঙ্গিদের খুঁজে বের করার কাজে রত ছিল।’
আবীর বাড়ি ছাড়ে ১ মার্চ, জিডি হামলার আগের দিন : ঈদের দিন শোলাকিয়ায় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের সংঘর্ষে নিহত আবীর রহমান সচ্ছল পরিবারের সন্তান। তার বাবা সিরাজুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। থাকেন বারিধারা এলাকায়। আবীরের দুই ভাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। গতকাল দুপুরে তাঁদের বাসায় গেলেও কড়াকড়ির কারণে ভেতরে ঢোকা কিংবা কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়নি। ইন্টারকমে আবীরের ভাই বলেন, ‘বাবা অসুস্থ। গুলশানের ঘটনার পর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জড়িত থাকার খবর আসায় আমরা ভয় পেয়ে যাই। পরে নিহত জঙ্গিদের ছবি মিলিয়ে নিশ্চিত হই এখানে আবীর নেই। তার মোবাইল ফোনে ফোন করলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। গত বুধবার ভাটারা থানায় জিডি করা হয়। ফেসবুক ও গণমাধ্যমে ছবি দেখে আমরা এবার নিশ্চিত হয়েছি, আবীরই শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে মারা গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আবীর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা একটু উচ্ছৃঙ্খল হয়—অনেকের এমন ধারণা থাকলেও আবীর তেমন ছিল না। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার। গত ১ মার্চ আবীর আব্বু ও আম্মাকে বলে, পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়ায় যাবে। ওনারা তাকে বলেন, তোমার দুই ভাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, গেলে অস্ট্রেলিয়ায় যাও। কিন্তু সে মালয়েশিয়াই যাবে বলে পণ করে। এ নিয়ে আব্বুর সঙ্গে বাগিবতণ্ডা হয়। তাকে বকাঝকা করলে ওই দিন সন্ধ্যায়ই সে বাসা থেকে চলে যায়।’ দেরিতে জিডি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আশায় বুক বাঁধতে বাঁধতে আমাদের জিডি করতে দেরি হয়ে যায়।’
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবীরের নিখোঁজের ব্যাপারটি আমরা তদন্ত করেছি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। আবীরের পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলব।’
নিবরাসের মা-বাবার চিঠি : গুলশানে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম ও মা গত বুধবার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এতে তাঁরা বলেন, তাঁদের একমাত্র ছেলে নিবরাস উন্নত শিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হয়। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সে দেশে আসে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সে নিখোঁজ হয়। একটি চিরকুটের মাধ্যমে তা জানিয়ে যায় সে। চিঠিতে তাঁরা আরো বলেন, ‘গুলশানের ঘটনায় নিবরাস জড়িত থাকায় আমরা লজ্জিত। দেশবাসীসহ সারা বিশ্বের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। যে ছেলেটি নিজের হাতে ভাত খেতে পারত না তার হাতে কারা গুলি, বোমা, গ্রেনেড তুলে দিল? আমরা সেই সব ব্যক্তি, গোষ্ঠীর বিচার চাই আল্লাহর দরবারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যেককে খুুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিক। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, আমাদের ক্ষমা দিন।’
এদিকে রোহান ইমতিয়াজের বাবা ও আওয়ামী লীগ নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বাবুল এবং মীর সমিহ মোবাশ্বেরের বাবা মীর হায়াত কবিরও তাঁদের সন্তানদের কৃতকর্মের জন্য দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/07/10/379046#sthash.EDWq5oOR.dpuf