মুফতি মাহফুজ আবেদ,বার্তা২৪
৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা। মসজিদে হারামে মাগরিবের নামাজ শেষ করে একজন বয়স্ক মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে যান পবিত্র কাবার দিকে। হাতে সোনালী কারুকাজ করা একটি সবুজ ব্যাগ। মক্কার ইমাম, নিরাপত্তা কর্মীসহ অন্যরাও আছেন। কিন্তু তিনি একাই কাবার গায়ে লাগানো বিশেষ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে পবিত্র কাবার দরজাটা খুললেন।
অথচ আমাদের কাছে পরিচিত দৃশ্য হলো, কোনো উপলক্ষে পবিত্র কাবার দরজা খোলা হলে সেখানে প্রচুর ভীড় থাকে। কিন্তু অনেকেরই এটা অজানা, কাবার দরজা খোলার সময় ওই বয়স্ক লোকটি থাকেন একেবারে একা। এভাবে একা কাবার দরজা খোলার রীতি চলে আসছে চৌদ্দশ’ বছর ধরে। বংশ পরম্পরায় তারা এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
কাবার দরজার তালা খোলার অধিকার শুধু তার। তার কাছে রক্ষিত থাকে পবিত্র কাবার দরজার চাবি। সৌদি আরবের বাদশাহ, মক্কার গর্ভনর, মসজিদে হারামের প্রধান খতিব, সরকারি কোনো কর্মকর্তা কিংবা অফিসে নয়- পবিত্র কাবার চাবি বহন ও সংরক্ষণ করেন তিনি।
কে তিনি?
আর কেনইবা তার কাছে চাবি থাকে?
কী এমন রহস্য?
এই সৌভাগ্যবান মানুষটির নাম শায়খ সালেহ আল শাইবা। তিনি সাহাবি হজরত উসমান ইবনে তালহা (রা.)-এর ১০৮তম উত্তরসূরি। মক্কা বিজয়ের দিন হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত উসমান ইবনে তালহার হাতে কাবার চাবি দেন এবং অনাগতকালে তার বংশেই কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। চৌদ্দশ’ বছর পরেও নবী করিম (সা.)-এর সেই ওয়াদা বহাল আছে। এখনও ওই বংশের কাছেই কাবার চাবি থাকে। শায়খ সালেহ আল শাইবা ওই বংশের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি, তাই তিনিই এখন পালন করছেন কাবার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব।
মক্কা বিজয়ের পর থেকে বিগত চৌদ্দশ’ বছরে অনেক শাসক, সুলতান, রাজা-বাদশাহ মক্কা-মদিনায় কর্তৃত্ব করেছেন। কিন্তু কাবার দরজা খোলার কর্তৃত্ব হজরত উসমান ইবনে তালহার বংশধররা করে আসছেন।
কীভাবে এ দায়িত্ব পেলেন?
মক্কা বিজয়ের দিন। মক্কার সবকিছুই সেদিন হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধীন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমানের কাছে কাবার চাবি চাইলেন। বরকতময় সে চাবি সঙ্গে সঙ্গে নবীর (সা.) হাতে তুলে দিলেন উসমান। চাবি নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে বায়তুল্লাহর দরজা খুললেন। ভেতরে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন।
কাবার চাবি দেখাচ্ছেন শায়খ সালেহ, ছবি: সংগৃহীত
বাইরে তখন অপেক্ষমান জনতা। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হওয়ার পর সবাই সীমাহীন কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কাকে দেওয়া হবে কাবার চাবি, কে পাবে এই মোবারক দায়িত্ব?
হজরত আব্বাস (রা.) এবং হজরত আলী (রা.) উপস্থিত ছিলেন সেখানে। দু’জনই চাবি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। এমনকি তারা এ ব্যাপারে আবেদনও করেছিলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে।
কিন্তু না, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নবী করিম (সা.) দরাজ গলায় ডাকলেন উসমান ইবনে তালহাকে। তার হাতেই দিলেন কাবার চাবি। বললেন, ‘এখন থেকে এ চাবি তোমার বংশধরের হাতেই থাকবে, একেবারে কেয়ামত পর্যন্ত। তোমাদের হাত থেকে এ চাবি কেউ নিতে চাইলে সে হবে জালিম।’
উসমানের মনে পড়ে গেলো হিজরতের আগের ঘটনা। হিজরতের আগে প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার কাবার দরজা খোলা হতো। এ দু’দিন লোকেরা আল্লাহর ঘরে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করতো। একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকজন সাহাবাকে নিয়ে বায়তুল্লায় প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন উসমান ইবনে তালহা, তিনি তখনও মুসলমান হননি।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্যের সঙ্গে উসমানের বাধা মেনে নিলেন। সেই সঙ্গে বললেন, ‘উসমান! একদিন তুমি এই চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। আমি তখন যাকে ইচ্ছে চাবিটা দেব।’
বিভিন্ন সময় কাবায় ব্যবহৃত তালার চাবি, ছবি: সংগৃহীত
এর পর উসমান ইবনে তালহা ইসলাম কবুল করেন। ৪২ হিজরিতে তার মৃত্যু হয়। ইসলাম পূর্ব জাহিলী যুগ ও ইসলাম পরবর্তী যুগে কাবার চাবির রক্ষক বংশধররা। সেই ধারা এখনও চলমান। তাদের কাছ থেকে চাবি নিয়েই বিভিন্ন সময় সৌদি আরবের বাদশাহ এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করে থাকেন। তারাই কাবার দরজা খুলে দেন।
সাহাবি উসমান ইবনে তালহার ‘বনি শাইবা’ গোত্রের কাছে কাবার চাবি থাকা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো বিতর্ক হয়নি। ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত এই গোত্রের বংশধরদের কাছেই কাবার চাবি রক্ষিত থাকবে।
৫৮ বার কাবার তালা-চাবি বদলানো হয়েছে
এ পর্যন্ত অসংখ্যবার কাবার তালা-চাবি পরিবর্তন করা হয়েছে। কাবা ঘরের চাবি একটি বিশেষ ব্যাগে রাখা হয়। এই ব্যাগটি পবিত্র কাবা ঘরের গিলাফ নির্মাণ কারখানায় বানানো হয়। কাবা ঘরের চাবি কখনও হারায়নি। তবে বহু বছর পূর্বে এক ব্যক্তি এই চাবি চুরি করেছিল। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার নিকট হতে কাবা ঘরের চাবি ফেরত নেওয়া হয়।
আব্বাসী, আইয়ুবী, মামলুক ও অটোম্যান যুগে কয়েকবার কাবা ঘর মেরামত করা হয়েছে। তখন প্রয়োজন মতে নতুন তালা-চাবিও বানানো হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর সর্বশেষ কাবা ঘরের চাবি পরিবর্তন করা হয়। এখনও ওই তালা-চাবি ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সির বরাতে একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ সালে সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ সিটি সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে কাবা ঘরের পুরাতন তালাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
পবিত্র কাবার দরজা তালা, ছবি: সংগৃহীত
এর প্রেক্ষিতে একটি বিশেষজ্ঞ দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ৩০ বছরের পুরনো মরচে ধরা তালা পরিবর্তন করে। তারা ১৮ ক্যারট সোনা দিয়ে তৈরি একটি নতুন তালা বানিয়ে দেন। বর্তমানে ব্যবহৃত তালার চাবির দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার। এই তালার আগের তালাটি অটোম্যান বাদশাহ আবদুল হামিদ খানের নির্দেশে ১৩০৯ হিজরিতে বানানো হয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত তালা-চাবি বাদে বাকি ৫৭টি তালা ও চাবি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে ৫৪টি চাবি রয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ঐতিহাসিক তোপকাপি জাদুঘরে, ২টি চাবি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্বখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে এবং আরেকটি মিসরের কায়রোর ইসলামিক আর্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামপূর্ব যুগেও কাবা ঘরের যেকোনো ধরনের সেবাকে সৌভাগ্যের কারণ মনে করা হতো। এ কাজে যারা নির্বাচিত হতেন সমাজে তারা পরিচিত হতেন সম্মানিত ও মর্যাদাবান হিসেবে। তখন কাবা ঘরের বিভিন্ন সেবা ভাগ করে দেওয়া হতো বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন মানুষের মাঝে। যেমন, হাজিদের জমজমের পানি পান করাতেন হজরত আব্বাস (রা.)। কাবায় আলো জ্বালানোসহ আরও কিছু দায়িত্ব ছিলো নবীজীর চাচা আবু তালেবের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় কাবা ঘরের চাবির দায়িত্বে ছিলেন উসমান ইবনে তালহা।
করোনাভাইরাসের কারণে এখনও মসজিদে হারামের জামাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সীমিত মানুষের অংশগ্রহণে মসজিদে হারামে জামাত ও জুমা চালু রয়েছে। তবে রীতি অনুযায়ী সবকাজ সম্পন্ন করা হয় নিয়ম মেনে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ সেপ্টেম্বর, রাতে কাবা ধোয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ ওই দিন খোলা হয় কাবার দরজা। আর দরজা খুলে দেন শায়খ সালেহ আল শাইবা।
পাঠকের মতামত