দশ বছর পর ঢাকায় সমাবেশ করার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাজনীতিতে কোনঠাসা হয়ে থাকা জামায়াতে ইসলামী। আলোচনা উঠেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জামায়াত বিষয়ক নীতি নিয়েও। সবমিলিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৬ মাস আগে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হঠাৎ কেন রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে জামায়াত- তা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব নিকাশ।
তাহলে আওয়ামী লীগ কি রাজনৈতিক চাপে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিল? নতুন করে জামায়াতের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা কি রাজনীতিতে নতুন মেরুকরন সৃষ্টি করবে? কি কারণে সরকার জামায়াতকে সহ্য করছে? এমন নানা প্রশ্ন, নানা কৌতুহল জেগেছে রাজনীতির ময়দানসহ নানা মহলে।
তবে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সমাবেশ করে বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার একদিন পর রবিবার সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নীতি পরিবর্তন করেনি। জামায়াত এখনও নিষিদ্ধ দল নয়। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে ইনডোরে (ঘরোয়া) সমাবেশ করতে পারে। দলটি সমাবেশের অনুমতি চাওয়ার পর পুলিশ নিরাপত্তা যাচাই করে তাদের অনুমতি দিয়েছে।
জামায়াত প্রসঙ্গে রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ১০ বছর পর জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ায় আওয়ামী লীগের নীতির পরিবর্তন হয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াত একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। দেশের অনেক অনিবন্ধিত দলই বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করে। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাদের সভা-সমাবেশ ইনডোরে করতেই পারে। তারা ইনডোরে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, ডিএমপি কমিশনার সেটা যাচাই করে অনুমতি দিয়েছে।’
সাধারণত জামায়াত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে তাদের সমাবেশ করে থাকে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘এসব সমাবেশে অনেক সময় আমরা দেখেছি যে তারা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে। এসব কিছু মাথায় রেখেই তাদের ইনডোরে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করতে সংশোধিত আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য কিছু দিনের মধ্যে কেবিনেটে (মন্ত্রী পরিষদ) যাবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, বিচারের মাধ্যমে চূড়ান্ত রায় না হওয়া এবং দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না।
জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। অন্যদিকে দলটিকে ১০ বছর পর সমাবেশের অনুমতি দেওয়া সাংঘর্ষিক কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, জামায়াতকে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধে বিচার করার জন্য আইন সংশোধন করার কথা, সেই প্রক্রিয়া চলমান। সংশোধনের জন্য যে আইন সেটি কেবিনেটে কিছু দিনের মধ্যে যাবে।’
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই (সমাবেশের) অনুমতি দিয়ে থাকে। উনারা কী বিবেচনায় অনুমতি দিয়েছেন, আমার মনে হয়, এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আপনারা যদি প্রশ্ন করেন, সেটা বেটার (ভালো) হবে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, এটা সাংঘর্ষিক। তার কারণ হচ্ছে, বিচার করার পরে যতক্ষণ পর্যন্ত রায় না হয়, দোষী সাব্যস্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তো আমি বলতে পারব না জামায়াত দোষী। বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং বিচারের প্রক্রিয়ায় আমি আজকেই বলব না যে কী হবে।’
‘অবশ্যই বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার করেছি সেখানে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, জামায়তকে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধে বিচার করার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। কিন্তু বিচার করার পরেই বলা যাবে তারা দোষী কি না। সেই জন্য আমি মনে করি না এটা সাংঘর্ষিক।’
জামায়াত প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জামায়াত এখনো যেহেতু নিষিদ্ধ হয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে আবেদন করেছে, সে জন্য তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, শনিবার জামায়াতের সমাবেশে আস্ফালন করে যেভাবে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, এগুলো আসলে বিএনপিরই বক্তব্য।
তথ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ২০১৪ সালে তারা যেভাবে নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে শতশত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো, সেটারই ইঙ্গিত তারা দিয়েছে। বিএনপি জোটের প্রধান শরিক জামায়াতকে দিয়ে তারা এই কথাগুলো বলিয়েছে। তাদেরকে সুযোগ দিলে তারা কি করতে পারে সেটি তাদের বক্তব্যে পরিস্কার হয়েছে।’
তবে ভিন্ন কথা বললেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তার ভাষ্য হচ্ছে- ‘জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের বিচারে ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালে বিচারে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ২০১৩ সালে আদালত রায় দেয়। এরপর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরু করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। ঢাকা টাইমস্