কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকা দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই মাদক চোরাচালান যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবহারও। এতে উদ্বেগ বাড়ছে।
সর্বশেষ শনিবার অস্ত্রের কারখানার সন্ধান পায় র্যাব। সেখান থেকে ছয়জনকে আটকের পর র্যাব জানতে পেরেছে এই অস্ত্রের একটা অংশ যেত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সবকিছু মিলিয়ে ওই এলাকা অস্থির হয়ে উঠেছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি। আপাতত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।’
এদিকে টেকনাফের হ্নীলা রঙ্গীখালি এলাকার দুর্গম পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানা ও ডাকাত দলের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে শনিবার ছয় ডাকাতকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব-১৫।
এ সময় ডাকাত দলের অস্ত্রের কারখানা থেকে দুইটি একনলা লম্বা বন্দুক, চারটি এলজি, একটি অর্ধনির্মিত এলজি, সাত রাউন্ড শটগানের কার্তুজ, ১০ রাউন্ড রাইফেলের কার্তুজ, একটি ড্রিল মেশিন, একটি আগুন জ্বালানোর মেশিন, দুইটি লেদ মেশিন, দুইটি বাটাল, দুইটি লোহার পাইপসহ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১৫ এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর সৈয়দ সাদিকুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই চক্রের প্রধান ফয়সাল উদ্দিন ওরফে ফয়সালকে আমরা পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতার করেছি। গহীন পাহাড়ে একাধিক ডাকাত চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় আছে। ডাকাত চক্র প্রতিনিয়ত এলাকাবাসী এবং অন্যান্য এলাকা থেকে আগত পর্যটকদের নানাভাবে হয়রানিসহ খুন, অপহরণ ও ধর্ষণ জাতীয় অপরাধ সংঘটিত করে আসছে। সন্ত্রাসীরা র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। আমরাও পাল্টা গুলি করি। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’
এই অস্ত্র কোথায় যায়? জানতে চাইলে জনাব হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছেও যায় এই অস্ত্র। আসলে ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত এখানে মাদকের অত বেশি বিস্তার ছিল না। রোহিঙ্গারা আসার পর মাদকের বিস্তার বেড়েছে। আর এই মাদকের কারণে অস্ত্রের ব্যবহারও বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সীমান্তের এত কাছে যে, অপরাধীরা কোনোভাবে সীমান্ত পার হলেই এদের ক্যাম্পে চলে আসে। আর কোনো সন্ত্রাসী যদি ওই ক্যাম্পে একবার ঢুকে পড়ে তাহলে তাকে ধরা বেশ কঠিন। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমরা অভিযান করি। গত এক বছরে এই এলাকা থেকে আমরা প্রায় দেড়শ’ অস্ত্র উদ্ধার করেছি।’
শুধু এবারই নয় গত জানুয়ারিতে টেকনাফে টানা নয় ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ডাকাতদলের ছয় সদস্যকে আটক করে কোস্টগার্ড। তখন কোস্টগার্ডের কর্মকর্তা লে. কমান্ডার বি এন আব্দুর রহমান বলেছিলেন, ‘শাহপরী দ্বীপ সংলগ্ন নাফ নদীর মোহনায় একটি সক্রিয় অস্ত্রধারী ডাকাতদল ফিশিং বোটে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড স্টেশন সেন্টমার্টিন কর্তৃক নাফ নদীর মোহনায় একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ডাকাত সদস্যরা দ্বীপের বনের মধ্যে লুকিয়ে যায়।’
পরবর্তী সময়ে কোস্টগার্ড স্টেশন টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের আভিযানিক দল দুটি যৌথভাবে দ্বীপটি চারদিক থেকে ডাকাত দলের মূল আস্তানা ঘেরাও করে ছয়জন সশস্ত্র ডাকাত সদস্যকে আটক করতে সক্ষম হয়। তখন তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল দুটি, একনলা বন্দুক তিনটি, এলজি দুটি, শটগান একটি, দেশি পিস্তল ছয়টি, ম্যাগাজিন চারটি, তাজা গোলা ৪৫০ রাউন্ডসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এত অল্প জায়গায় এত বেশি মানুষ থাকলে নিরাপত্তা সংকট তো হবেই। এখন এই সংকটের সমাধান যেভাবে সম্ভব, সেটা তো হচ্ছে না। ওদের ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এখন সেটা তো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমাদের যেটা করা দরকার, সেটা হলো, নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও কঠোর করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যহত রাখতে হবে, যাতে দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরানো যায়।’
এদিকে গত মাসেও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। অষ্টম এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর তখন বলেছিলেন, ক্যাম্পে দুই দল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে আরও দুইজন মারা যান। এই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। জানা গেছে, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব থেকেই এই সংঘর্ষ। এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সূত্র: ডয়চে ভেলে
পাঠকের মতামত