মাদকের বৈশ্বিক ব্যবসা নিয়ে আফগানিস্তানের মধ্যে এক ধরনের ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ আছে। কখনো মাদক উৎপাদনে ব্যাপক জোর দেয় দেশটি, আবার কখনো কখনো কমিয়ে ফেলে উৎপাদন। আফগানিস্তানের এমন আচরণের সুলক সন্ধান করতে গেলে উঠে আসে অনেক অকথিক সত্য।
সেই সত্যগুলোর দিকে নিবিড় দৃষ্টি দেওয়ার আগে সাদা চোখে যা দেখা যায়, তার দিকে একটু নজর বুলানো যেতে পারে। যেমন, বিশ্বে মাদক উৎপাদনে এখনো শীর্ষ অবস্থানটি আফগানিস্তানের। এই তথ্য ব্রিটিশ সাময়ীকি দ্য ইকনোমিস্টের।
ইকনোমিস্ট বলছে, আফগানিস্তানে মাদকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে একসময় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও সফল হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র সফল হতে পারেনি নাকি সফল হওয়ার চেষ্টা করেনি, সেটি অবশ্য তর্কসাপেক্ষ বিষয়। তবে যে বিষয়ে তর্ক নেই, সেটি হচ্ছে, কুড়ি বছর প্রত্যক্ষভাবে আফগানিস্তান দখলে রাখার সময় বেশ কয়েকবার মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর ২০২১ সালে তালেবান গোষ্ঠী সরকার গঠন করে এবং মাদক উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তালেবানদের এ উদ্যোগের নেপথ্য কারণ কী, তা তালেবান নেতারা স্পষ্ট করে না বললেও ধারণা করা যায়, নিজেদের নৈতিক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে ও বিশ্বব্যাপী শরিয়া রাষ্ট্রের ধারনা দিতে তাঁরা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালেবান সরকারের এ পদক্ষেপের কারণে দেশটিতে মাদক উৎপাদন কমেছে। এর ফলে যেটি হবে, মিয়ানমার, চীন, ভারত বা মেক্সিকোর মতো দেশ বৈশ্বিক মাদকের বাজার দখল করে ফেলতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আফগানিস্তান কি সেটি আদৌ হতে দেবে? মনে রাখা দরকার, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করার আগে পর্যন্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতি দাঁড়িয়েছিল পপি ও আফিম বাণিজ্যের ওপর। এখন তালেবানের নিষেধাজ্ঞার কারণে মাদক উৎপাদন যদি ব্যাপকভাবে কমে যায়, তাহলে দেশটির অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। আবার নিষেধাজ্ঞা না দিয়েও পারা যাচ্ছ না, কারণ ইসলামি আইনে মাদক হারাম (নিষিদ্ধ)।
মাদকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তালেবানরা
মাদকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তালেবানরা। ছবি: টুইটার
বুঝতে অসু্বিধা হয় না, নিকট ভবিষ্যতেই উভয়সঙ্কটে পড়বেন তালেবান নেতারা। অর্থনীতি বাঁচাবেন নাকি শরিয়া আইন বাঁচাবেন, এ নিয়ে অবধারিতভাবেই দোটানায় পড়তে হবে তাঁদের। তখন তাঁরা কী সিদ্ধান্ত নেন (নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন কিনা), তা দেখার জন্য আমাদের আপাতত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
এই সুযোগে আমরা আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকাতে পারি। যুক্তরাজ্যভিক্তিক প্রতিষ্ঠান আলসিসের স্যাটেলাইটে তোলা ছবি বলছে, আফগানিস্তানে দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশে সবচেয়ে বেশি পপি চাষ হয়। ২০২০ সালের এপ্রিলে ওই এলাকায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পপি চাষ হয়েছে। কিন্তু এক বছর পর তা কমে (নিষেধাজ্ঞার কারণে) এসেছে ১ হাজার হেক্টর জমিতে।
একই দৃশ্য আরেকটি বড় পপি উৎপাদনকারী প্রদেশ নানগারহারেও। ওই প্রদেশে গত বছর ৭ হাজার হেক্টর জমিতে পপি চাষ হয়েছিল। এ বছর হয়েছে মাত্র ৮৬৫ হেক্টর জমিতে।
অন্যান্য প্রদেশগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে ২৫ বছর ধরে গবেষণা করেন ডেভিড ম্যানসফিল্ড। তিনি বলেন, গত বছর থেকে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের পপি চাষ ৮৫ শতাংশ কমে গেছে।
এভাবে কমতে থাকলে, এর একটা প্রভাব তো পড়বেই সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। কারণ আফিম ব্যবসার সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ জড়িত। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মনে রাখা দরকার। সেটি হচ্ছে, সারা বিশ্বের ৮৫ শতাংশ আফিম উৎপাদন করত আফগানিস্তান। অতএব বুঝতে অসুবিধা হয় না, আফিম চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে দেশটির মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি কতটা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব তথ্য ও বাস্তবতা কি তালেবান নেতারা বোঝেন না? না বুঝেই তাঁরা মাদক উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবানরা বুঝেশুনেই এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কারণ এর আগেও তালেবানদের এমন নজির রয়েছে। ২০০০ সালের দিকে তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও পপি চাষ নিষিদ্ধ করেছিল। তখন পপি চাষ ৮২ হাজার হেক্টর থেকে কমিয়ে মাত্র ৮ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছিল তৎকালীন তালেবান সরকার।
পরে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান দখলের পরে মাদক উৎপাদনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় মার্কিন সরকার। ফলে আবার আফিম উৎপাদন বাড়তে থাকে আফগানিস্তানে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, নিজেদের প্রয়োজনে কখনো কখনো মাদক উৎপাদনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আবার কখনো কখনো মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে আফগানিস্তানে। শুরুতে যে লুকোচুরির গল্প বলা হয়েছিল, সেটি মূলত এখানেই লুকিয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজেদের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, আবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, তেমনি তালেবানরাও এখন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো তুলে নেবে। এই লুকোচুরি লুকোচুরি খেলাই যেন আফগানিস্তানের নিয়তি।
তালেবান সরকার এক সময় এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে যে বাধ্য হবেন, সেটির ইঙ্গিত এখনই স্পষ্ট। কারণ অনেক এলাকায় কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে। যেমন কান্দাহার এলাকার পপিচাষী হাজি মোহাম্মদ জান বলেন, আমার ২ হেক্টর জমির পপি বাগান ধ্বংস করে দিয়েছে তালেবান সরকারের লোকজন। আমি তালেবানের সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশনাকে সম্মান করি। কিন্তু নির্দেশনাটি সব কৃষকের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়৷
এসব জনক্ষোভ ও অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কাকে উপেক্ষা করেও যদি তালেবান তাদের নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে তখন কী হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তখন আফগানিস্তানের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে মিয়ানমার ও মেক্সিকোর মতো আফিম উৎপাদনকারী দেশগুলো। তারা মাদকের বৈশ্বিক বাজারটি দখল করে নিতে পারে।
ইতিমধ্যে মিয়ানমারে পপি চাষীদের প্রণোদনা ও উৎসাহ দিতে দেখা যাচ্ছে জান্তা সরকারকে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে মিয়ানমারে বর্তমানে পপি চাষ বেড়েছে।
জানুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনও বিবিসির প্রতিবেদনকে সমর্থন করছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে পপি চাষ আগের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
মিয়ানমান সঙ্কট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন টম কিন। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির কারণেই মিয়ানমারে আফিম উৎপাদন বেড়েছে, এমন উপসংহারে আসা উচিত হবে না। তবে ধারণা করা যায়, আফগানিস্তানের নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারে মাদক উৎপাদন বাড়ানোয় ইন্ধন জোগাতে পারে।
টম কিন ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, মিয়ানমার এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাদক উৎপাদনকারী দেশ হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই তার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।
দ্য টেলিগ্রাফের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে মাদক উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা যত দীর্ঘমেয়াদি হবে, বিশ্বজুড়ে আফিমের দাম তত বাড়বে। কারণ উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে আফিমের আন্তর্জাতিক মজুত এক সময় নিঃশেষ হয়ে আসবে। আর এই সুযোগেই বাজারে প্রবেশ করবে মাদকের নতুন কারবারিরা। যেমন, মিয়ানমার।
এ ছাড়া উপযুক্ত জলবায়ুর কারণে ভারত, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আফিম উৎপাদন বেড়ে যেতে পারে বলে গত জুনে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ট্রান্সফর্ম ড্রাগ পলিসি ফাউন্ডেশন।
মাদকের বৈশ্বিক বাজার এখন এক টালমাটাল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই বাজার বরাবরের মতো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকবে নাকি মিয়ানমার অথবা অন্য কোনো দেশের দখলে চলে যাবে, তা এখনই হলফ করে বলার উপায় নেই।