বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে (এসআইবিএল) নগদ টাকার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ জন্য প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত চলতি হিসাবও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সংকট মোকাবিলায় ৮৫০ কোটি টাকা বিশেষ ধার চেয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে ব্যাংকটি। গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসআইবিএল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসআইবিএলের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যাংকটির যে পাওনা (কনফার্ম রিসিভেবল) অর্থ রয়েছে, সেটার বিপরীতে এই তহবিল চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে এসআইবিএল। ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় সবশেষ বড় পরিবর্তন আসে ২০১৭ সালের অক্টোবরে। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। গত বছরের শেষ সময়েও বিশেষ ধার চেয়ে আবেদন করেছে ব্যাংকটি। তাতে সাড়া দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিনের জন্য ব্যাংকটিকে দেড় হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দেয়। মূলত ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি ভালো দেখাতে তখন ধার নেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও ধার চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম আমাদের সময়কে বলেন, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য কলমানি, রেপো ও বিশেষ রেপো আছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য এ ধরনের সাপোর্ট নেই। পদ্ধতিগত কারণে এ ধরনের সাপোর্ট আমরা নিতে পারি না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছিলাম।’
পরে সহায়তার প্রয়োজন নেই বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন জাফর আলম। তবে কবে জানানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিঠি দেওয়ার কয়েকদিন পর আমরা মৌখিকভাবে কেন্দ্রƒীয় ব্যাংককে বলেছি, এই সুবিধা আর আমাদের লাগবে না। ফলে আবেদনটিও প্রসেস করার প্রয়োজন নেই।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। একে বলা হয় ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর)। এ ছাড়া গ্রাহকদের আমানতের ন্যূনতম শতাংশ নগদ, স্বর্ণ বা অন্যান্য সিকিউরিটিজ আকারে রাখতে হয়। একে সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) বলা হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ন্যূনতম সিআরআর প্রয়োজন নগদের ৪ শতাংশ এবং এসএলআর প্রয়োজন আমানতের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, নগদ টাকার সংকটের কারণে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে এসআইবিএল। নিয়মিত জরিমানা করা হচ্ছে ব্যাংকটিকে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মতো জরিমানা গুনেছে ব্যাংকটি। সম্প্রতি নগদ টাকার সংকট আরও তীব্র হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত আন্তঃব্যাংক লেনদেন নিষ্পত্তিও বন্ধের উপক্রম হয়েছে। কারণ তাদের এ সংক্রান্ত চলতি হিসাব অনেক দিন ধরেই ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। আগামী ২০ দিনের মধ্যে আলোচ্য হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ রাখতে না পারলে লেনদেন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে এসআইবিএলসহ ৫টি ইসলামী ব্যাংককে সতর্ক করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘আপনাদের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে চলতি হিসাবের স্থিতি ঋণাত্মক, যা স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি বারবার গোচরীভূত করা হলেও এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় পত্র পাওয়ার ২০ কর্মদিবসের মধ্যে আবশ্যিকভাবে চলতি হিসাবের ঋণাত্মক স্থিতি সমন্বয়ের পরামর্শ দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ডিসেম্বরে এসআইবিএলের নগদ টাকার সংকট ছিল ৮০৯ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। মাঝখানে জুনে তা ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকায় ওঠে। সূত্রগুলো বলছে, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকেও নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা ফেরত আসছে না। এ কারণে ব্যাংকটির নগদ টাকার সংকট বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে ওই ঋণ অনিয়মের ঘটনা উঠে আসে।
এ ছাড়া এসআইবিএলের বিরুদ্ধে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কমানোর অভিযোগও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ মানের ঋণে পরিণত হয়েছে ১ হাজার ৫৭০ কোটি। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি হবে। কারণ ২০২১ সালে ব্যাংকটির হিসাবে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন দেখা যায়, এসআইবিলের আরও ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণখেলাপি হওয়ার যোগ্য। ওই খেলাপিযোগ্য ঋণ নিয়মিত করতে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এসব ঋণ পরবর্তী সময়ে নিয়মিত করা হয়েছে কিনা সেই তথ্য দিতে ব্যাংকের কেউ রাজি হয়নি।
সুত্র: দৈনিক আমাদের সময়
পাঠকের মতামত