বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। গত শুক্রবার দাম বেঁধে দিলেও গতকাল রবিবার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেঁধে দেওয়া পণ্যের দাম কেবল কাগজে-কলমে আছে, সরকারি দামে বাস্তবে কোনো পণ্যই মিলছে না।
সরকারি দামে পণ্য মিলছে নাএসব পণ্যের বেশির ভাগই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আগের মতোই ইচ্ছামতো দামে পণ্য বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে পণ্যের দাম না কমলে তাঁদের কমিয়ে বিক্রি করার সুযোগ নেই। এদিকে দাম কমার খবর শুনে বাজারে গিয়ে নির্ধারিত দামে না পেয়ে হতাশ হচ্ছে ভোক্তারা।
রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী কাঁচাবাজার ও জোয়ারসাহারা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির দাম ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার, কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা দরে। সোনালি মুরগি কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হলেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দর ২৬২ টাকা।
সরকার নির্ধারিত ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সা কেজির গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। চাষের পাঙ্গাশ মাছ কেজি ১৮০ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারণ করে দিলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৪০ টাকায়। দেশি পেঁয়াজ খুচরায় বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়, সরকারের বেঁধে দেওয়া দর ৬৫ টাকা ৪০ পয়সা। দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়, সরকার নির্ধারিত দর ১২০ টাকা ৮১ পয়সা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে বেগুন বিক্রি হওয়ার কথা, কিন্তু খুচরায় ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের দর ৬০ টাকা ২০ পয়সা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রায় ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বাঁধাকপি ও ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে প্রায় ১২ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে খুচরায় শিম বিক্রি হচ্ছে। খুচরায় টমেটো কেজি বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়, সরকার নির্ধারিত খুচরা দর ৪০ টাকা ২০ পয়সা।
সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া পণ্যের তালিকায় আরো রয়েছে ছোলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, কাতল মাছ, ছাগলের মাংস, ডিম, খেজুর, চিড়া, বেসন, সাগর কলা ও মিষ্টি কুমড়া।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা উৎপাদন খরচ হিসাব করে তার ভিত্তিতে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে পণ্যগুলোর দাম নির্ধারণ করেছে। প্রতিটি পর্যায়ে নির্ধারিত হারে মুনাফা ধরা হয়েছে। আইনটির বিধিমালায় কোন পণ্যে কোন পর্যায়ে কত মুনাফা করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১৪৬ টাকা। তারা উৎপাদনকারী, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফা যোগ করে এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ১৭৫ টাকা।
জানতে চাইলে আমদানিকারক ও পাইকারি শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজারে সরবরাহ বাড়ানো গেলে সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে পণ্য কিনতে পারবে ভোক্তারা। কারণ বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে, আবার সরবরাহ কমলে দাম বেড়ে যায়। এখন বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ার কারণে পাইকারিতে দাম এক সপ্তাহে কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে।
আব্দুল মাজেদ বলেন, শ্যামবাজারে পাইকারিতে আজ (গতকাল) প্রতি কেজি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৪০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আগামী তিন মাস ভোক্তারা কম দামে পেঁয়াজ পাবে। এরপর মৌসুম শেষ হলে যদি আমদানি করে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ানো না যায় তাহলে আবার দাম ঠিক রাখা যাবে না। তাই বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে।
গতকাল রাজধানীর বাড্ডার মেসার্স ভ্যারাইটিজ স্টোরের ব্যবসায়ী মো. শিপন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের নির্ধারিত দরে আমরা বিক্রি করব তো দূরের কথা, পাইকারি বাজার থেকেও এই দামে কিনে আনতে পারিনি। আমরা পাইকারি বাজার থেকে যে দামে পণ্য ক্রয় করি, তার চেয়ে কিছুটা লাভে বিক্রি করি। সরকার যতই দাম বেঁধে দিক, যদি পাইকারি বাজার থেকে কম দামে কিনতে না পারি, তাহলে সেই দাম কখনোই কার্যকর হবে না।’
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দামে আমরা কিনতেই পারছি না। লোকসান দিয়ে কি ব্যবসা করব? আমরা সর্বোচ্চ কেজিতে ১০ টাকার বেশি লাভ করি না। আজ (গতকাল) বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করা হয় কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা এবং সোনালি মুরগি কেজি মানভেদে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকায়।’
সরকার নির্ধারিত দরে পণ্য না পেয়ে ভোক্তারা অভিযোগ করে বলছে, সরকার ২৯ পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েই দায় সারছে। সরকারের নির্দেশনা বিক্রেতারা যে কেন মানছেন না, সেই বিষয়টি তদারকি করা হচ্ছে না। বরং ঠকে যাচ্ছে ভোক্তারা।
রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে গতকাল দেখা হয় মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি রাজধানীতে ভাড়ায় মোটারসাইকেল চালানোর কাজে নিয়োজিত। জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, টিভি ও পত্রিকার খবরে দেখলাম সরকার পণ্যের দাম কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে এসে পণ্যের দামের মধ্যে কোনো হেরফের দেখতে পেলাম না। গত শুক্রবারে যে দামে পণ্য কিনেছি, এখনো সেই দামেই বাজারে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তারা যদি নির্ধারিত দরে পণ্য কিনতে না পারে তাহলে নতুন করে বেঁধে দেওয়া দর কাদের জন্য?
এ বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার ২৯ পণ্যের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে এটি খুবই ভালো দিক। এই দরে ভোক্তারা পণ্য কিনতে পারলে ভোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসবে। তবে এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বাজারে পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর। সরবরাহ বাড়ানো না গেলে এই নির্ধারিত দরের সুফল ভোক্তারা পাবে না।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে চলে আসবে। এর জন্য সমন্বিতভাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা—সবাই মিলে সমন্বয় করবেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পণ্যের একটা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ অধিদপ্তরের নিজস্ব জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি আছে। আমরা যেহেতু বাজার মনিটর করি, আমরা সমন্বয় করে মনিটর শুরু করব। প্রাইস ডিসকভারিটা হুট করে হয় না। আমাদের দায়িত্ব হবে উৎপাদক পর্যায় থেকে পাইকারি এবং পরে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত বাজার মনিটর করা।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল দুপুরে রাজধানীর টিসিবি ভবনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়হীনতার কোনো অভাব নেই উল্লেখ করে আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘একটি জিনিস আপনি যখন যৌক্তিক পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করবেন, সঙ্গে সঙ্গে এটি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। আগে এটি নির্ধারণ করা জরুরি ছিল। অনেক দিন ধরে আইনটি ছিল, কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিদপ্তর, ডিসি, ইউএনও—আমরা এখন সবাই মিলে সমন্বয় করব। আশা করি এটি একটি যৌক্তিক পর্যায়ে চলে আসবে।’
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমরা যেখানে যাচ্ছি বাজার কমিটিকে নিয়ে বসছি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসছি, তাঁদের এনকারেজ করছি। তাঁদের সমস্যার সমাধান করে এটি (সঠিক দামে পণ্য বিক্রি) আমরা বাস্তবায়ন করছি। আমরা কোনো জায়গায় কোনো দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি না বা তালাবদ্ধ করে দিচ্ছি না। যাঁরা একেবারেই আইন মানছেন না, তাঁদের আমরা শাস্তির আওতায় আনছি।’
গত শুক্রবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিমের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-এর ৪(ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত দামে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অনুরোধ করা হলো। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম বলেন, মাত্র সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হতে সময় লাগবে। আশা করছি, বাজার নিজে থেকেই সংশোধিত হবে। যদি না হয়, যেখানে যেখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বা হস্তক্ষেপ দরকার, ওই সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার আগে তিন মাস ধরে আমাদের কর্মীরা মাঠে কাজ করেছেন। এখানে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্ব করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চ পচনশীল পণ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মুনাফা দেওয়া হয়েছে। সুত্র: কালেরকন্ঠ
পাঠকের মতামত