সেন্টমার্টিন দ্বীপের ইতিহাস ঘেঁটে কবে প্রথম এই দ্বীপটি মানুষ শনাক্ত করেছিল তা জানা যায় না। প্রথম কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বড় বড় জাহাজে যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিকে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করত।
কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপকে জিঞ্জিরা নামেই চিনত। ১৮৯০ সালের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ।
কালক্রমে এই দ্বীপ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেওড়া এবং ঝাউগাছ ছিল। তবে বাঙালি জেলেরা পানির তৃষ্ণা মেটাতে এবং ক্লান্তি দূর করার লক্ষ্যে দ্বীপটিতে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় ‘নারিকেল গাছ প্রধান’ দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। এ কারণে দ্বীপটিকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামেও অভিহিত করা হয়। অথচ সেই নারিকেল জিঞ্জিরাতেই এখন আর দেখা মেলে না ডাব ও নারিকেলের। একটা সময় দ্বীপটির শত শত নারিকেল গাছে প্রচুর ডাব ধরত এবং ডাবগুলোও হতো বড় ও সুস্বাদু। টানা দুই দিন সরেজমিন সেন্টমার্টিন ঘুরে একটি ডাবেরও দেখা মেলেনি।
নারিকেল জিঞ্জিরায় ডাব-নারিকেল না পাওয়ার পেছনে দ্বীপবাসী কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে প্রধান কারণটি হচ্ছে-এখানকার নারিকেল গাছে এক ধরনের সাদা মাছির উৎপাত শুরু হয়েছে বিগত কয়েক মাস ধরে। এই মাছি দ্বীপের নারিকেল গাছসহ অন্যান্য গাছপালাও ধ্বংস করছে। ঐতিহাসিকভাবে সেখানে শতাধিক প্রজাতির গাছ ছিল। গত এক যুগে নারিকেল ও কেওড়াগাছ ছাড়া বাকিগুলো বিলুপ্তির পথে। সাদা মাছির কারণে গত কয়েক মাসে ৩০০ নারিকেল গাছ মারা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, এই সাদা মাছি নারিকেল গাছসহ অন্যান্য গাছের পাতায় বসে এক ধরনের লালা নির্গত করে। তাদের ধারণা মাছির এই লালা বিষাক্ত। এই বিষাক্ত লালা যখনই কোনো মাছি গাছের পাতায় ঢেলে দেয় তখন ধীরে ধীরে পাতাগুলো শুকিয়ে যায়। নারিকেল গাছের যে পাতায় মাছি বসে সেটি ধীরে ধীরে শুকনো পাতার মতো হয়ে যায়। দ্বীপবাসীর আরও ধারণা নারিকেল গাছে যখন ডাবের কাঁদি আসে এবং কাঁদি ও ছড়া যখন বের হতে শুরু করে তখন তাতে ফুল থাকে। সে ফুলে মাছি বসার কারণেই ডাবের কাঁদিতে কুঁড়ি ধরে না। আর নারিকেল গাছের কাঁদিটিও ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। এ কারণেই গাছে এখন আর ডাব ধরে না।
এমন তথ্য জানিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা মৌলভী আবদুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপের নারিকেল গাছগুলোতে এত বড় বড় ডাব ধরত যা আমরা ছোটবেলায় একটি ডাব তুলতে পারতাম না। আমার এই ৬০ বছরের জীবনে কখনো গাছগুলোকে ডাবশূন্য দেখিনি, যা এখন দেখতে পাচ্ছি। কেন এমনটি হচ্ছে-এটা নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও মাছির আক্রমণের কারণেই যে গাছগুলো ডাবশূন্য হয়ে পড়ছে-এটা আমরা এক রকম নিশ্চিত। কারণ মাছিগুলো গাছের যে পাতায় বসে, সেটিই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। একইভাবে ডাবের ছড়া যখন আসে তখন এতেও মাছি বসে নষ্ট করে দেয়। এ কারণেই ডাবগাছে এখন আর আমরা ডাব পাই না। তবে আমি মনে করি বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভাবা দরকার। আসলে কী কারণে এমনটি হচ্ছে-গবেষণা করে সেটি বের করা দরকার। কারণ সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম একটি উপকরণ ছিল এই দ্বীপের ডাব। আগে দ্বীপের প্রধান বাজার ছাড়াও মোড়ে মোড়ে বা রাস্তার ধারে ডাব বিক্রি হতো। অথচ এখন আর চোখেই পড়ে না।
দ্বীপের আরেক বাসিন্দা তুরাব আলী শিকদার সময়ের আলোকে বলেন, ‘শুধু ডাবগাছে ডাব ধরছে না বিষয়টি তেমন না, এখানকার অন্যান্য গাছেও ফল ধরছে না এবং গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। সেন্টমার্টিনে শুধু যে গাছের ওপরই এ রকম প্রভাব পড়েছে তা কিন্তু নয়, এই দ্বীপের চারপাশে আগে প্রচুর মাছ ধরতাম আমরা। শামুক-ঝিনুক, শৈবাল আসত প্রচুর। এখন আর কোনোটিই তেমন পাওয়া যায় না। পরিবেশগত কোনো সমস্যার কারণে এমন হয়েছে কি না বা অন্য কোনো কারণে এমনটি হয়েছে কি না সেটা আমরা বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, আল্লাহ আমাদের ওপর নাখোশ হয়েই এসব কিছু দ্বীপ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।’
অবশ্য পরিবেশবিদরা বলছেন, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ যে আগের মতো নেই, সেটা তো নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে কোনো কারণে দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে গবেষণার দরকার রয়েছে।
এ মন্তব্য করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত সময়ের আলোকে বলেন, ‘দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য নষ্টের পেছনে যেমন দ্বীপবাসীর দায় রয়েছে, তেমনই সরকারেরও দায় রয়েছে। কারণ সেখানে দেদার পর্যটক গিয়েছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের গাছ-পালা, সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। তবে সেন্টমার্টিন যেহেতু একটি পর্যটন স্পট, সেখানে দেশের মানুষ ঘুরতে যাবেই, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কড়া নজরদারি থাকলে হয়তো সমস্যা দেখা দিত না। আর গাছে মাছির আক্রমণসহ যেসব বিষয়গুলো উঠে এসেছে, অবশ্যই সেগুলো নিয়ে সরকারি পর্যায়ে গবেষণার দরকার রয়েছে।’
সেন্টমার্টিন নামকরণ হয় যেভাবে : জানা যায়, ১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরিপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে একজন খ্রিস্টান সেন্টমার্টিনের নামানুসারে সেন্টমার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্টমার্টিন নামেই পরিচিতি লাভ করে। আবার আরেকটি মত অনুসরে, ১৯০০ সালে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়।
ভৌগোলিক আয়তন : সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।
ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা বা উত্তর পাড়া। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় দক্ষিণ পাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সংকীর্ণ লেজের মতো এলাকা ও সংকীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট দ্বীপ আছে যা স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া, সিরাদিয়া বা ছেঁড়া দ্বীপ নামে পরিচিত। এটি একটি জনশূন্য দ্বীপ। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় নৌকা প্রয়োজন হয়। সুত্র। সময়ের আলো