আমাদের সময়ের প্রতিবেদন
আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিপক্ষে অধিকাংশ দল
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা ওঠায় রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেটি দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে।
অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের মূল এজেন্ডা হতে পারে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বেশি প্রাধান্য পেলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, অনেকে এমন ভাবনাকে দুরভিসন্ধিমূলক বলেও মনে করছেন। কয়েকটি দল অবশ্য স্থানীয় নির্বাচন আগে করার পক্ষপাতি, যদিও এ সংখ্যাটি নগণ্য।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ গত সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে নানাবিধ উদ্যোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ বেশি আসছে। মানুষ বলছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এ শূন্যতা দূরীকরণে তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন চাইছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, নাকি জাতীয় নির্বাচনÑ এ নিয়ে স্থানীয়দের মতামত নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয়
পর্যায়ের নেতাদেরও একই মত। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা চাকরিজীবীদের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এটা পার্টটাইম হিসেবে তারা করতে পারবেন।
কমিশন প্রধানের ভাষ্য, দলীয় সরকারের পরিবর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকে, তাদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনকালীন যে সরকার দায়িত্ব পালন করবে, তার মেয়াদও বাড়ানো যেতে পারে। এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড সদস্য, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নারী কাউন্সিলর এবং উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের কার্যকর ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করতে হবে। ‘না’ ভোটের পরিমাণ বেশি হলে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন করতে হবেÑ অনেক আগে থেকেই এমন দাবি উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তাই স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধানের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া জোরালো হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচন আগে করার তাগাদা দিয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া। তা না করে যদি আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবে সরকার, তাহলে তাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চাইছে। অবশ্যই এ সরকার তা করবে না।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় এসেছে, এগুলোর বটম লাইনটা কী। সেই বটম লাইনে যদি সবাই একমত হয়, তাহলে তা ঠিক করে জাতীয় নির্বাচনে চলে যাওয়া ভালো। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমাদের ইস্যু না। যদি তারা করতে চায়, তাহলে করুক। এই বিষয়ে আমরা বলতে চাই না। যে সমস্যা ও সংকট আছে, সেদিকে আগে খেয়াল করাই ভালো। প্রসঙ্গক ক্রমে তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে আমরা দলীয় মার্কাভিত্তিক নির্বাচন চাই না।
নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার অভিপ্রায় থেকে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে চায় সরকারÑ এমনটা মনে করছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়ার প্রশ্নই আসে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দিয়ে নিজেদের পাওয়ার বেজকে গড়ে তোলার চেষ্টা করার মতো বিতর্কিত বিষয়ের মধ্যে যাওয়ার দরকার কী? সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেক্সিমাম দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাবে। তাই তো? দেড় বছর প্রশাসক দিয়ে চালিয়ে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচিত সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেবে। তা না হলে কনফিউশন, ভুল বোঝাবুঝি ও চরিত্র হনন এসব চলতেই থাকবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচনটাই হচ্ছে মানুষের প্রত্যাশা। ১৬ বছর মানুষ এই জাতীয় নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। এটাই প্রধান এজেন্ডা। এ সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যুক্ত করাটাকে বিবেচনার কাজ হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার চিন্তাটা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিলম্বিত বা দীর্ঘায়িত করার একটা অপকৌশল কিনাÑ এ নিয়ে মানুষের মধ্যে এরই মধ্যে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলব, এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না, যাতে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যায় এবং সরকার আবার নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমার মনে হয়, নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের জন্যই তৈরি হচ্ছে। সবার উচিত হবে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা, যাতে এ বছরের মধ্যেই বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার পক্ষপাতি গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটা বিশেষ সংকটের মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা সবার সহযোগিতা পাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের একটা গুণগত পরিবর্তন আমরা চাই। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় তরুণরা নেতৃত্বের প্রশ্নে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়নি। তরুণদের সম্ভাবনা আছে, মানুষেরও তাদের প্রতি আগ্রহ আছে। এদিকে দৃষ্টি রাখা জরুরি। পাশাপাশি সরকারের পাঁচ মাসের যে প্রত্যাশা, হিসাব করলে দেখা যাবে, তারা সেভাবে এগোতে পারছে না। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের যে কেন্দ্রবিন্দু স্থানীয় সরকার, তা একেবারেই অচল। সেক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করে এই কার্যক্রমকে গতিশীল করা যায়। স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে অন্যসব নির্বাচনের জন্য সরকারের কাছে একটা দৃষ্টান্ত।
পাঠকের মতামত