উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা শরনার্থী অধ্যূষিত এলাকায় এনজিও কর্তৃক স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভিন্ন ধরনের কৃষি (!) উপকরণের নামে দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ দেয়ার সম্প্রতি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এনজিওদের সরবরাহ দেয়া তথাকথিত কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় অস্ত্র সমুহ হলো-দা, নিড়ানি, হন্তী, কোদাল, শাবল, বেলচা, চুরি, লাঠি ইত্যাদি। যে দ্রব্য গুলো দিয়ে সহজেই মারামারি, সংঘর্ষ, প্রতিপক্ষকে হামলা, সন্ত্রাসী কাজ, দাঙ্গা হাঙ্গামা ও উত্তেজনাকর অপরাধমূলক কাজে সহজে ব্যবহার করা যায়। গত দু’বছরে রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প এলাকায় বিভিন্ন সাংঘর্ষিক কাজে এ জাতীয় দেশীয় অস্ত্র গুলো ব্যাপক ব্যবহারের চরম অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এনজিও মুক্তি’র তৈরী করতে দেয়া হাজার হাজার পিচ এজাতীয় তথাকথিত কৃষি উপকরণ কামারের দোকানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়েছে। যে গুলো কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় অস্ত্র হিসাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ দেয়ার কথা ছিলো বলে মুক্তি এনজিও নিজেরা স্বীকার করেছে।
এ জাতীয় গুরুতর অভিযোগে এনজিও ব্যুরো কর্তৃক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এনজিও মুক্তি’র চলমান ৬ প্রকল্প। এনজিও মুক্তি’র এ বিষয়ে বক্তব্য ছিলো-তথাকথিত এসব কৃষি উপকরণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে বিতরণের জন্য তৈরি করা হচ্ছিল। আগেও তারা কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রী রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর একইভাবে এনজিও শেড এর উখিয়াস্থ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে দেশীয় অস্ত্রের মতো অনুরূপ তথাকথিত কৃষি উপকরণ।
এনজিও শেড এর কার্যালয় হতে উদ্ধারকৃত মালামালের বিষয়ে একইদিন উখিয়ার ইউএনও’র কাছে প্রামাণ্য কাগজপত্র দাখিল করায় জব্দকৃত মালামাল গুলো এনজিও শেডকে ফেরত দেয়া হয়েছে। এনজিও শেডকে কৃষি(!) উপকরণ সমুহ জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম (আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা) উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ও জালিয়া পালং ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় অস্ত্র হিসাবে বিতরণের জন্য দিয়েছিল বলে তারা দাবি করেছেন।
দা, নিড়ানি, হন্তী, কোদাল, শাবল, বেলচা, চুরি, লাঠি ইত্যাদি প্রকৃতপক্ষে কৃষি উপকরণ কিনা-এ বিষয়ে জানতে চাইলে, কক্সবাজারস্থ কৃষি অধিদপ্তরের উপ পরিচালকের কার্যালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকতা জানান,
সেগুলো কোনভাবেই কৃষি উপকরণ নয়। কৃষি বিভাগের মতে, কৃষি উপকরণ হলো-সার, বীজ, পাওয়ার টিলার, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, কীটনাশক, কীটনাশক ছিটানোর মেশিন, চাষযোগ্য চারা ইত্যাদি। দা, নিড়ানি, হন্তী, কোদাল, শাবল, বেলচা, চুরি, লাঠি ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই কৃষি উপকরণের আওতায় পড়েনা বলেসিবিএন-কে দৃঢ়তার সাথে জানান, উক্ত কৃষিবিদ কর্মকর্তা। তাহলে, প্রশ্ন হলো-কেন জাতি সংঘের সিস্টার অরগানাইজেশান আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) শেড নামক একটি এনজিও-র মাধ্যমে দা, নিড়ানি, হন্তী, কোদাল, শাবল, বেলচা, চুরি, লাঠি ইত্যাদি দেশীয় তৈরী অস্ত্র তাদের ভাষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ দিচ্ছে কেন। যদিও সচেতন নাগরিকেরা বলেছেন, সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কাজে সহজে ব্যবহারযোগ্য দেশীয় অস্ত্রের মতো এ সামগ্রী গুলো মূলতঃ রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পের শরনার্থীদের মাঝে সুকৌশলে সরবরাহ দেয়ার জন্য তৈরী ও মজুদ করা হয়েছিলো।
অতীতেও তারা এরকম দেশীয় অস্ত্র সামগ্রী রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে তথাকথিত কৃষি উপকরণের নাম দিয়ে হাজারে হাজারে সরবরাহ করেছে। আর ‘মুক্তি’ নামক এনজিও কেন হাজার হাজার পিচ এ জাতীয় দেশীয় অস্ত্র সামগ্রী স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ দেয়ার নামে সকলকে বিভ্রান্ত করলো। এরকম কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রী আরো অন্যান্য এনজিওরা রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন এসব দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রী সরবরাহ দেয়ার বিষয়ে যখন অভিযোগ উঠছে, তখন এনজিও গুলো বলছে, এসব দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রী রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সরবরাহ দেয়ার জন্য নয়, ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ দেয়ার জন্যই তৈরী ও মজুদ করা হচ্ছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাথার উপর আর কতো কাঠাল ভেঙ্গে খাওয়া হবে!
উখিয়া-টেকনাফ উপজেলা সহ যেসব উপজেলায় রোহিঙ্গা শরনার্থী রয়েছে সেখানে কেন দেশীয় তৈরী অস্ত্রের মতো ব্যবহাযোগ্য এসব উপকরণ সরবরাহ দেয়া হচ্ছে? যেসব দেশীয় তৈরী অস্ত্র দিয়ে সহজে সাংঘাত সৃষ্টি করা যায়, অপরাধ কর্মে ব্যবহার করা যায়, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা যায়, ভয়ানক ও সন্ত্রাসী কাজমর্মে বহন ও ব্যবহার করতে সহজ হয়, খুনখারাবি সংঘটিত করা যায় ইত্যাদি অস্ত্র সামগ্রী কেন রোহিঙ্গা শরনার্থী অধ্যূষিত উখিয়া-টেকনাফ সহ পাশ্ববর্তী এলাকা গুলোতে নিয়মিত কৃষি(!) উপকরণের নামে সরবরাহ দেয়া হবে? রোহিঙ্গা শরনার্থী আগমনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে যদি সরবরাহ দিতেই হয়, তাহলে দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রীর পরিবর্তে অন্য কোন নিত্যপয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করলে তার চেয়ে অনেক ভাল ও নিরাপদ হতো। প্রয়োজনে নগদ অর্থও দিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সহজে সহযোগিতা করা যায়। কারণ কৃষি (!) উপকরণের নামে এনজিওদের মাধ্যমে প্রদত্ত দেশীয় তৈরী অস্ত্র সামগ্রী জীবনযাত্রার অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদান নয়। এছাড়া এনজিও এবং আইএনজিও গুলোর মাধ্যমে কেন এসব দেশীয় তৈরি অস্ত্র সামগ্রী সরবরাহ দেয়া হবে? সরকারি সংস্থার মাধ্যমে অথবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এসব সামগ্রী খুব সহজেই সরবরাহ দেয়া যায়। আর এনজিও এবং আইএনজিও গুলোর সাম্প্রতিক তৎপরতায় সবার কাছে ধারণা জম্মেছে যে-তাদের উপর জেলা প্রশাসন, রোহিঙ্গা প্রশাসন সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলোর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে বলে পরিলক্ষিত হয়নি। এ অবস্থায় সামগ্রিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হলো-রোহিঙ্গা শরনার্থীদের দ্বারা সম্ভাব্য সাংঘাত, অপরাধ কর্ম, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকান্ড ঠেকাতে এখন থেকে এনজিও এবং আইএনজিও’র মাধ্যমে তথাকথিত কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় তৈরী অস্ত্র সরবরাহ দেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা সহ পাশ্ববর্তী এলাকা গুলোতে তথাকথিত কৃষি(!) উপকরণ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করা আবশ্যক হয়ে পয়ে পড়েছে। এসব তথাকথিত কৃষি সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ নাপেলে স্থানীয় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা মোটেও নেই।
আর সরকারিভাবেও রোহিঙ্গা শরনার্থী অথবা ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও এ ধরনের তথাকথিত কৃষি উপকরণের নামে দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ নাদেওয়াটাই উত্তম কাজ হবে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সংস্থা গুলোর গুরুত্বের সাথে এখনি ভেবে দেখা দরকার।
অবশ্য সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরনার্থী কেন্দ্রীক অনেক অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটার পর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মাসিক এনজিও সমন্বয় সভায় রোহিঙ্গা শরনার্থীদের শুধুমাত্র ফুড আইটেম ছাড়া অন্য কোন ননফুড অইটেম কোনভাবেই সরবরাহ দেয়া যাবেনা বলে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন এনজিওদের সোজাসাপটা জানিয়ে দেন। সভায় এনজিও এবং আইএনজিও গুলোকে আগের মতো লাগামহীন কোন কাজ করতে দেয়া হবেনা বলেও জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন তাদেরকে কড়া হুশিয়ারী দেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়, তা এখন দেখার বিষয়।
মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী
(লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা।)