হার মেনেছে কল্পনা। হার মেনেছে রূপকথা। সততা ও নিঃস্বার্থ পরোপকার ও মানব প্রেমের এক অসাধারণ উপাখ্যান তৈরি হয়েছে কক্সবাজারে। যে বাংলাদেশ মানুষকে ভীত করে। অনিশ্চয়তা ও হতাশার চাদরে মুড়ে দেয়। এটি সেই মলিন বাংলাদেশ নয়, এটি কুলীন বাংলাদেশের গল্প। এই গল্প মর্মস্পর্শী। এই গল্প হৃদয়কে স্পর্শ করে সহজেই।
এর মোরাল অফ দ্যা স্টোরি কি? সেটা হচ্ছে, ভালোবাসা মরে যায়নি। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা হারিয়ে যায়নি। বিশ্বাস হারানো তাই পাপ, এই আপ্তবাক্য এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
আমরা প্রতিদিনের জনজীবনে, পারিবারিক জীবনে উচ্চারণ করি, আসলে খুব বেশি কিছু হবে না আমাদের। নীতি, নৈতিকতা, সততা এই সমাজ থেকে উঠে গেছে। অবশ্যই অনেকখানি উঠে গেছে। কিন্তু সবখানি নয়। আমাদের চেনাজানা জগতের মানুষের জীবনে যা বাস্তবতা, যা সত্য, সেটা সবার জীবনে সত্য নাও হতে পারে। সুতরাং আমার কিংবা আপনার জানাটাই, সব নয়। বাংলাদেশে অনেক কিছুতেই ধস নেমেছে। এটা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশে চেঞ্জ মেকার্স নেই, সেটাও সত্য নয়। হতে পারে তারা আমাদের চেনা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে নেই। কিন্তু তারা আছে। তারা নতুন প্রজন্মের অহংকার হতে পারে। কারণ আমাদের আশাবাদ দরকার। লাইটহাউজ দরকার। কারণ মানবতাকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে বাংলাদেশকে। এজন্য একটি নৈতিক, সৎ , সকৃতজ্ঞ বাংলাদেশ প্রয়োজন। আলোচ্য চরিত্রটি নানা কারণে দুর্দান্ত। আমাদের কল্পনা শক্তিকে স্তব্ধ করে দেয়। কারণ আমরা গরিব মানুষের কোটিপতি হওয়ার গল্প জানি। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার গল্প জানি। কিন্তু ব্যক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি মানবিক, মেধাবী ও সজ্জন ব্যক্তির স্ফুরণ ঔপন্যাসিকের ক্ষুরধার কলমকে হার মানিয়েছে। আমাদের চারপাশের জীবন জগৎ ও ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো মিল নেই। আমরা যাকে বলি ইমাজিনেশন, আমরা যাকে বলি সিনেমা, আমরা যাকে বলি ফিল্মি স্টাইল, আমরা যাকে বলি শুধুই অ্যাবসার্ড, সে সবই সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দেশের গণতন্ত্রের পরিস্থিতি, দেশের মূল্যবোধের পরিস্থিতি, মানুষ মানুষের ভালোবাসার পরিস্থিতি, আজ কমবেশি মলিন কিংবা লণ্ডভণ্ড। এটা হয়তো শুধুই এই ভূখণ্ডের সীমাবদ্ধতা নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ অনেক কিছুরই ঘাটতি প্রকট। হতাশা গভীর। কিন্তু সেইসব ঘাটতি যেমন সত্য, দুঃখ-বেদনা বঞ্চনা, ব্যর্থতা, ক্ষোভ-হতাশা যেমন সত্য, তেমনি এই গল্প সত্য। এই মানুষটির গল্প অসাধারণ কেন? শূন্য থেকে বর্ণাঢ্য জীবন ও সম্পদশালী হয়েছেন বলেই কিন্তু নয়। তিনি নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠেন, যখন তিনি সমুদ্রের বালুকাবেলায় নিমজ্জিত হতে বসা গাড়িটিকে টেনে তুলেন, বন্ধুদের নিয়ে, একেবারেই কিছুই না পাওয়ার আশা করে। তিনি আমাদের কল্পনা শক্তিকে পরাস্ত করেন, যখন তিনি তার অপ্রকাশিত, দিলদরিয়া, পরোপকারী মানুষটির দেয়া টাকা ফিরিয়ে দেন। কারণ তাতে মানবতার অবমাননা হবে। মানবিক আবেদনে সাড়া দেয়া নিয়ে তিনি বিকিকিনি করতে চান না। আবার শ্রমের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের কিছু অর্থ উপার্জন পর্বটি হাতছাড়া হওয়া বেদনাবোধ তিনি নাকচ করতে পারেন না। তাই তিনি গাড়ি টেনে তুলে দিতে সাহায্যকারী বন্ধুদের প্রাণের জুস খাওয়ান, নিজের টাকায়। কারণ বন্ধুদের কোমল অনুভূতিতে তিনি আঘাত দিতে পারেন না।
তার গল্প ক্লাইমেক্স থেকে প্রায় অ্যান্টি ক্লাইমেক্সে উঠে যায়, যখন তিনি তার সাহায্যকারীর কাছ থেকে অকাতরে ২২ লাখ টাকা পাওয়ার পরে নিজকে ঋণী ভাবেন। ঋণের বোঝার ভার তিনি বয়ে বেড়াতো তার পরিশীলিত মন তাকে বাধা দেয়। সে কারণে জমিটি আরো বেশি সময় ধরে রেখে আরো বেশি আয়ের লোভ তিনি সংবরণ করেন। তিনি দ্রুত জমিটি বেচে দিয়ে ঋণ শোধ করেন। হাজার হাজার কোটি টাকা যারা লুটছেন, তারা ঋণের ভারকে কোনো ভারই মনে করেন না। তিনি সংবেদনশীল, আপদমস্তক। তাই সেই ভিক্ষুককে আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন যার কাছ থেকে তিনি নগদ ১৫ টাকা আর একটা ছেঁড়া শার্ট পেয়েছিলেন। তিনি হয়তো ওই নারীকে কখনো পেতে পারেন, নাও পেতে পারেন। কিন্তু তার এই অপেক্ষাটাই তাকে মহামানবের গুণাবলিতে ঋদ্ধ করেছে। তিনি তার মনের অজান্তে, সন্তর্পণে সেই নারীর প্রতি তার গভীর কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছেন।
সম্পদশালী জীবন তার সেই বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে মুছে দিলেও ভালোবাসার হাহাকার তাকে তাড়া করছে। অভাবী জীবনের বিপরীতে অঢেল সম্পদ তাকে অকৃতজ্ঞ করেনি, স্পর্ধিত করেনি। বরং তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অকপট বয়ান তাকে করেছে বিনয়াবনত। আরজে কিবরিয়া যেমনটা বলেছেন আমরা অনেক সময় মোটিভেশনের কথা বলি। উদাহরণ খুঁজি। কিন্তু তিনিই একটি জীবন্ত মডেল। ইউটিউবে শত শত মানুষের তীব্র আবেগভরা মন্তব্যগুলো এক এক গুচ্ছ গোলাপ ও রক্তকরবী হয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে তাকে। জয়তু মানবতা।
‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি হতে পারে না?’ সবথেকে জনপ্রিয় এই গানের কলিটি যে কত সত্য সেটা দুজন মানুষ রচনা করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ধনবান মহৎ হৃদয় আর তার সারথী একদা গরিব মানুষটি।
শূন্য হাতে একসময় যে হাকিম একটি পয়সা কিংবা একটু খাবারের জন্য অপেক্ষা করেছেন দিনের পর দিন, আজ তার হাতের মুঠোয় টাকা আর টাকা। সুখ আর স্বাচ্ছ্যন্দে ভরপুর জীবন। অতীতকে মনে করতে গিয়ে তিনি ফিরে যান অতীতে। বলেন, কষ্টের সময় দৈনিক মানবজমিন-এ আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। আর সেই লেখক সম্মানি পেয়েছিলাম ১০০ টাকার একটি প্রাইজবন্ড। এ সম্মানী যে আমার জীবনকে কত বদলে দিয়েছে আমি বলে বুঝাতে পারবোনা।
সম্প্রতি আরজে কিবরিয়ার ফেসবুক পেজে আবদুল হাকিমের জীবনের গল্প নিয়ে লাইভ প্রচারিত হওয়ার পর মানুষের হৃদয়কে ব্যাপক নাড়া দেয়। ২৯শে জানুয়ারি এটি প্রচার হওয়ার পর এ পর্যন্ত এটি ৭৯ হাজার শেয়ার হয়েছে। ৪৩০০ মন্তব্য আর ১লাখ ১১ হাজার লাইক পড়েছে। কিন্তু কি আছে হাকিমের জীবনে? তা জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। তখন হাকিমের বয়স তের কি চৌদ্দ বছর। একটু খাবারের আশায় কত জায়গায় যে গিয়েছেন তিনি তার ইয়াত্তা নেই। বাবার সহকর্মী থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব কোন জায়াগাই বাদ দেননি। কিন্তু বাবার অবর্তমানে কারো কাছেই ঠাঁয় পাননি। এমনকি বাবার রেশন কার্ড বিক্রির জমে থাকা সাপ্তাহিক টাকার জন্য গিয়েও বিফল হয়ে ফিরেছেন। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে রেশন কার্ড ক্রেতা টাকা দেননি। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে ১০ টাকা নিয়ে এসে মহাবিপদে পড়েন তিনি। টাকা ফুরিয়ে গেলে চোখে দেখেন অন্ধকার। রাতে মাজারে ঘুমাতে গিয়ে হারান শরীরের কাপড়। সকালে নিজেকে আবিস্কার করেন দিগম্বর হিসাবে। ছোট আবদুল হাকিম তখন ছালার চট দিয়ে লজ্জা নিবারণ করেন। এ সময়েই তার সঙ্গে দেখা হয় এক ভিক্ষুক মহিলার। যিনি এক সময় চট্টগ্রামে তাদের কোর্ট বিল্ডিংয়ের বাসায় আসা যাওয়া করতেন। তাদের বাসায় দুপুরের খাবার রেখে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যেতেন। হাকিমের মার কাছ থেকে নানাভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন ওই ভিক্ষুক মহিলা। সেই ভিক্ষুক মহিলা তাকে এমন অবস্থা দেখে সবই বুঝতে পারেন। নিজে গিয়ে কাপড় কিনে এনে আগে লজ্জা নিবারণ করেন। আরও কত কাহিনী হাকিমের জীবনে? সেসব জয় করে আজ আবদুল হাকিম কোটি কোটি টাকার মালিক। আলাদিনের চেরাগ নয়, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কে এই আবদুল হাকিম? তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়স তখন হাকিমের। এ সময়ে তার বাবা মিথ্যা চুরির অপবাদের বোঝা নিয়ে মারা যান। ছয় ভাই বোন আর মাকে নিয়ে পড়তে হয় মহাবিপদে। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে লাগলেন তার মা। এর পরের কাহিনী আরও করুণ। চট্রগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার বাসিন্দা আবুদর হাকিম। ছোট বেলায় শঙ্খ নদী কেড়ে নিয়েছিলো পৈত্তিক ভিটা। বাবা কাজ করতেন চট্রগ্রাম বিভাগীয় অফিসের দারোয়ান্ হিসেবে। সেই সুবাদে চট্রগ্রাম চলে আসেন পুরো পরিবার। একদিন তার বাবার অফিসের একটি টাইপ রাইটার চুরির ঘটনা ঘটে। এজন্য তার বাবাকে ২৯ দিন জেল খাটতে হয়। এমন অবস্থায় দারিদ্রতা আরো পেয়ে বসে তাদের। পরে কোর্টের রায় অনুযায়ী কক্সবাজার বদলি করা হয় তার বাবাকে। তখন হাকিমের পরিবার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার চলে যান। চাকরি জীবনে তার বাবা দশ হাজার সাত’শ টাকা জমিয়েছিলেন। কিন্তু কক্সবাজার আসার পর একটি চিঠি আসলো। টাইপ রাইটারটি চুরির ঘটনায় তার কাছ থেকে জমানো টাকাটা কেটে রাখা হবে। এই চিঠি পাওয়ার পরেই ১৯৭৭ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি। অনেকদিন পর বাবার চাকরিটা পান তার বড় ভাই। কিন্তু বড় ভাইও তাদেরকে তেমন দেখাশোনা করতেন না। মাসে দশ বারো কেজি চাল কিনে দিয়েই দায়িত্ব শেষ ছিলো তার । মানুষের বাড়িতে কাজ করে তার মা যে টাকা বা খাবার পেতো সেটা দিয়েই তাদের সংসার চালিয়ে নিতো মা। কোনোদিন খাবার পেতো তো কোনদিন পেতো না।
হাকিম বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমার খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে গেলাম। বাবার একটা রেশন কার্ড ছিলো। আমরা যখন চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসলাম তখন বাবা পাচঁটাকা লাভে এ্ই কার্ডটা একজনের কাছে বিক্রি করে দেন। আমরা প্রতি সপ্তাহে তখন পাঁচ টাকা পেতাম। বাবা মারা যাওয়ার পার চার পাঁচ সপ্তাহের টাকা জমাছিলো। তখন মা বলছিলো জমানো টাকাটা নিয়ে আসার জন্য। চট্রগ্রাম গেলাম আমি। কিন্তু যার কাছে কার্ডের টাকা পাব তাকে বাবা মারা গেছে বলতেই তিনি বললেন, কাল এসো টাকা দেবো। কাল গেলে আবার বলেন পরে এসো। বুঝতে পারলাম তিনি টাকা দেবেন না। কার্ডও দেবেন না। তখন আমার কাছে এক টাকাও ছিলো না। পেটের ক্ষুধায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার পরিচিত জনের বাড়ি বা আশে পাশে ঘুরছিলাম। কেউ খাবার দিলো না। কিন্তু আমি কারো কাছে হাতো পাতিনি। বাবা বেচে থাকতে মাঝে মধ্যে শাহ আমানত শাহের মাজারে নিয়ে যেতেন। সেখানে একটি লঙ্গরখানা ছিল। সেখান থেকে কিছু হালুয়া পেয়ে খেয়েছিলাম। সেইদিন রাতে মাজারে ঘুমিয়েছিলাম। তবে সকালে উঠে দেখি আমার শরীরে কোন কাপড় নাই। সকালে ওঠে যখন এই অবস্থা দেখি তখন আমি পাগলের মত এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করি লজ্জা নিবারনের জন্য । এক লোক আমাকে পাগল ভেবে একটি ছালার চট দিয়েছিলো। পরে আমি সেটা পড়ে র্কোট বিল্ডিংয়ের দিকে গেলাম এই আশায়, সেখানে যদি পরিচিত কোন লোকের সাথে দেখা হয় আমার সমস্যার একটা সমাধান হবে। বেলা শেষে শামসুন্নাহার খালার সাথে হঠাৎ করে দেখা হয়। তিনি সেখানে ভিক্ষা করতেন। সে আমাকে কাপড় কিনে দিলেন ও খাওয়ালেন। তার ভিক্ষার টাকার থেকে ১০ টাকা দিয়ে কক্সবাজারের একটা বাসের টিকেট কিনে দিলেন। আর ৫ টাকা হাতে দিলেন। সেই টাকা নিয়ে কক্সবাজার ফিরে গেলাম। শামসুন্নাহারের সঙ্গে তার পরিবারের পরিচয় অনেক আগে থেকেই। তার ছোট বোন যখন খুব ছোট ছিলেন, তখন তার মা ছোট বোনকে এই ভিক্ষুকের কাছে দিতেন। ভিক্ষুক শামসুর নাহার তার বোনকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করতেন। ছোট শিশু দেখে লোকজন ভিক্ষা দিতো। বিষয়টি তার বাবাও জানতেন না।
হাকিম বলেন , বাড়িতে এসে মাকে সব ঘটনা বল্লাম। মা খুব হতাশ হলেন। রেশন কার্ডের টাকাটাও পেলাম না। এই অবস্থায় আমাদের দিকে তাকানোর মতো কেউ ছিলো না। আমার ছোট বোন যখন ক্ষুধার যন্ত্রনায় কান্নাকাটি করত তখন মা কোরআন তেলোওয়াত করতেন। অনেক সময় মানুষ এসে বিভিন্ন ফল দিতেন, খাবার দিতেন। আমাদের জীবনে অনেক বেলা না খেয়ে কাটিয়েছি। যে বাড়িতে মা কাজ করতেন , কাজ শেষে মাকে কিছু খাবার দিতো । মা না খেয়ে তা আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। সবাইকে সমান ভাগ করে দিতেন। কিন্তু আমার বড় ভাইয়ের চাকরি হলেও আমাদের তেমন একটা দেখতেন না।’তবে আমার জীবনের উন্নতির পেছনে আমার ভাইয়ের আবদানটা বড় করে দেখি আমি । মাঝখানে একবার আমার টাইফয়েট হয়েছিল। আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার চেহারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। চুল উঠে গিয়েছিলো। কোন চিকিৎসা পাইনি। ১৭ দিন পরে মাকে বললাম মা আমি খাব। তখন আমার মা বলছিলো, আমার ছেলে এতদিন পরে খাবে, কিন্তু বাসায় তো কোনো খাবার নেই। তখন মায়ের পরামর্শে ভাইয়ের কাছে গেলাম। ভাইকে বললাম, দুইটি রুটি কিনে দিতে। ভাই আমাকে দোকান থেকে দুইটি চকলেট কিনে দিলেন । আমি জানি এটা আমার কিছু হবে না। ভাই চাইলে আমাকে আরো কিছু কিনে দিতে পারতেন। কিন্তু দিলেন না। আমি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে আমার জীবনের পরিবর্তনে মূল একটা কারন ছিল এটি।
চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোর হাকিমের তখনো পড়াশোনার হাতের খড়ি হয়নি। কিন্তু পড়াশোনার করার প্রবল ইচ্ছে হাকিমের। সেই ইচ্ছেই বাবার বন্ধু আব্দুল আজিজ নামের একজন বৃদ্ধ লোকের কাছে তিনি এই আবদার করেন। অনেক অনুনয়বিনয় করার পর তিনি তাকে তিনটি বাল্যশিক্ষা বই দিলেন। একেক করে বইগুলো পড়ছিলেন হাকিম। যারা পড়তে পারেন ,তাদের কাছে বার বার গিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি হাজার মানুষের কাছ থেকে শিখেছি। আমি রাস্তায় বাতির নিচে দাড়িঁয়ে পড়ালেখা করেছি। পরে একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছি। এই পড়াশোনা করতে গিয়ে মানুষের বাসায় কাজ করেছি। গরু-ছাগল পালন করেছি। রাস্তায় আখ বিক্রি করেছি, ট্রেনে বাদাম বিক্রি করেছি। এসএসসি পাশ করার পর কক্সবাজার কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ছয় মাস কলেজেও যাই। পরে অভাব অনটরে মধ্য দিয়ে আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি।’
পরে তার একটি চাকরি হয় ৭৮ টাকা বেতনে। তাও বছরে ছয় মাসের জন্য। ১৯৮২ সালে সরকারি চাকরি হয়েছিল জেলা জজ অফিসে। কিন্তু নিয়োগপত্র আর নেয়া হয়নি। তখনকার সরকার নিয়োগটি বন্ধ করে দিয়েছিলো। তিনি বলেন, একবার চাকরির জন্য এসে চট্রগ্রামে আটকে গেলাম এক বন্ধুর বাসায়। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। হরতালের পর হরতাল। অনেক দিন ধরে আমার বন্ধুর মা বকা ঝকা দিতেন আমার বন্ধুকে। বলতেন যেখানে তুই নিজের খাবার যোগাড় করতে পারিস না, সেখানে আরেকজনকে এনে কিভাবে খাওয়াবি। পরে আমি তাদের বাড়িতে কাজ শুরু করলাম। এরপরে আমাকে পেট ভরে খাবার দিতেন। একদিন আমার বন্ধুর মামাকে এক ট্রাক জ্বালানি কেটে দিয়েছেলাম । পরে মামা খুশি হয়ে তিন হাজার টাকা দিলেন। আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। পরে একটা অফিসে পিয়নের চাকরি পেলাম। তিনি বলেন ,আমি জীবনে অনেক বই পড়তাম। আমার জীবনে যতগুলো বই কিনে পড়েছি, তা দিয়ে অনেক সম্পত্তি কিনতে পারতাম।
জীবনে উত্থানপতনে ল্যান্ড সার্ভে কাজশুরু করলেন হাকিম। তখনকার কক্সবাজার জেলার ৪৯৫ টি আপিল মামলা ছিল সবগুলোর বাদির নাম বিবাদির নাম মৌজা সব গুলো মুখস্থ ছিলো তার। কক্সবাজার জেলার মৌজা, দাগ খতিয়ান সকল কিছু মুখস্থ ছিলো। দাগ নাম্বার বললে বলে দিতে পারতেন কোন বাড়িটা কার, কোনো জায়গায় জমিটি। দরিদ্র জীবনে অনেক কিছু দেখতে হয়েছে তাকে। হাকিম বলেন, আমার বাড়িতে তখন টিনশেড ঘর ছিলো। আমার ঘরে পানি পড়তো টিনের ছিদ্র দিয়ে, সেগুলোকে ঠিক করার জন্য একদিন ঘরের উপরে উঠলাম। চালে ওঠার পরে দেখি একটি গাড়ি পানির নিচে চলে যাচ্ছে। আমি দ্রুত গেলাম সেখানে । আমার আশে পাশে থেকে লোকজন এনে গাড়িটা উদ্ধার করি। তখনই সবাই বলছিলো অনেক বড়লোক । বিনিময় বেশি করে টাকা নিবি। আমি একটাকাও নেইনি। পরে ভদ্রলোক আমার বাসায় আসলেন অনেক কিছু নিয়ে। তার একটি ফোন নাম্বার দিল আমাকে । যেনো ঢাকায় গেলে তার বাসায় যাই, ফোন দেই। একদিন হঠাৎ করে একটা মামলার কাজে ঢাকা যাই, তার পরে ঐ ভদ্রলোকের বাসায় উঠি। তিনি আমাকে অনেক আপ্যায়ন করেন। খাবার দাবার খাওয়ান। খাবারের টেবিলে হঠাৎ করে তিনি ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। টাকা দেয়ার প্রস্তাবও দেন।
বেশকিছু দিন পর, হঠাৎ একদিন এক তহসিলদার চাকরি থেকে আবসর নিয়েছেন। তিনি হজে যাবেন একটা জায়গা বিক্রি করে। অনেক দামি জায়গা। দাম ২২ লাখ টাকা। কিন্তু এতো টাকা আমি পাবো কোথায়। পরে ঢাকায় ওই ভদ্র লোকের কথা মনে পড়লো। যেই মনে আসলো ,সেই ওনাকে ফোন দিলাম। তিনি বল্লেন, আগামি সপ্তাহে টাকাটা পাঠাবে। পরের সাপ্তাহে কল আসল ব্যাংকে টাকা চলে এসেছে। আমি খুশিতে কান্না করে দিলাম। জমিটা কিনলাম। সেই জমিটা তিন মাসের মাথায় ৪ ভাগের ৩ ভাগ ৭৫ লাখ টাকা বিক্রি করে ভদ্র লোকের ২২ লাখ টাকা দিয়ে দিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে এক টাকাও লাভ নেননি। তখন আমার হাতে ৫০ লাখ টাকা থাকে। তারপর আমি জমি কেনা বেচার ব্যবসা শুরু করি। সেই থেকে আমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আমি কক্সবাজারে দু’টি হোটেলের মালিক । স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার মালিক আমি।
একসময় আব্দুল হাকিম বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার ছিলেন। আব্দুল হাদি ,সুবির নন্দী থেকে শুরু করে অনেকেই তার গান গেয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০০ সালে দৈনিক মানবজমিন-এ একটি লেখা ছাপা হয়েছিলো। তখন আমি একশ টাকার একটা প্রাইজবন্ড পেয়েছি। লেখা ছাপা হওয়ার পর তখনকার মানবজমিনের কক্সবাজার প্রতিনিধির সহায়তায় স্থানীয় সাহিত্য একাডেমীতে কাজ শুরু করি। পরে ওখান থেকে আমার তিনটি বই বের হয়েছে। লেখালেখির প্রথম উৎসাহ ছিলো আমার মনবজমিন। প্রথম লেখা ছাপা হওয়া মানবজমিন পত্রিকাটি আমি এখনো রেখে দিয়েছি। বিশ বছর ধরে আমার কাছে পত্রিকাটি আছে।