ভারতের মুম্বাই শহরে সাগরের তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা মেরিন ড্রাইভ সড়ক। ছয় লেনের সড়কটির পাশেই গড়ে ওঠেছে পাঁচ থেকে দুই তারকা মানের ১১২টি হোটেল। সব হোটেলই সাগরমুখী।
সড়কে গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি সৈকত ঘিরে বিনোদনের জন্য রয়েছে আরো দুই লেনের ফুটপাত। জোয়ার এলেই আরব সাগরের ঢেউ উপচে পড়ে ফুটপাতে। আর রাতে সড়কটি হয়ে ওঠে আলোকসজ্জায় আরো অপরূপ।
আর মুম্বাইয়ের চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিনোদনের সব উপাদান রয়েছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও কক্সবাজার উপকূলে। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে পর্যটক টানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দেরিতে হলেও পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি থেকে দক্ষিণ কাট্টলীর রাসমনি ঘাট পর্যন্ত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাগর তীর ঘেঁষে ৯০ ফুট চওড়া একটি আউটার রিং রোড নির্মাণ করছে। ওই সড়ক ঘিরে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া হলে পুরো এলাকার চিত্রই পাল্টে যাবে।
এছাড়া কক্সবাজার কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত আরেকটি মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। ওই সড়কে একদিকে সাগর ও আরেকদিকে পাহাড়। যা মুম্বাইয়েও নেই। এই সড়ককেও কাজে লাগালে পর্যটক আকর্ষণে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এ প্রসঙ্গে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট নিয়াজ মোর্শেদ এলিট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি সৈকত জনপ্রিয় হওয়ার সব উপাদান রয়েছে পতেঙ্গা ও কক্সবাজারে। সেই উপাদানগুলো পর্যটকের কাছে ঠিকভাবে উপস্থাপিত না হওয়ায় জনপ্রিয়তা পায়নি। মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ পর্যটক আকর্ষণের একটি বড় সুযোগ। তবে মুম্বাইয়ের মতো সাগরের ঢেউ থেকে বাঁচতে সিমেন্টের টাইএঙ্গেল দিয়ে সড়কটিকে রক্ষা করতে হবে প্রথমে।’
তরুণ এ ব্যবসায়ী আরো বলেন, ‘সাগরের পাশে ব্র্যান্ডেড হোটেল রেস্টুরেন্ট তৈরি করা এবং সৈকতকেন্দ্রিক বিনোদনের ব্যবস্থা করা গেলে অনায়াসে মুম্বাই ও দুবাইয়ের মতো জনপ্রিয়তা পাবে পতেঙ্গা ও কক্সবাজার।’
মুম্বাইয়ে পর্যটকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এর নাম দেওয়া হয়েছে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সড়ক। সিমেন্ট কংক্রিট ঢালাইয়ে নির্মিত সড়কটির বড় সৌন্দর্য হচ্ছে বিশাল ফুটপাত। ফুটপাত ঘিরে খাবার থেকে শুরু করে বিনোদনের সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে সড়কের সৌন্দর্য, রাখা আছে গাড়ি পার্কিং সুবিধা। পাঁচতারা গ্র্যান্ড ওবেরয় হোটেল থেকে যেমন দেশি-বিদেশি পর্যটক ফুটপাতে আসছেন, তেমনি স্থানীয় নাগরিকদের কেউ সেখানে গিয়ে ব্যায়াম করছেন আবার কেউ বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিচ্ছেন। হাজার হাজার মানুষের আড্ডার মাঝখানে হয়তো সাগরের ঢেউও গায়ে আছড়ে পড়ছে।
একই সৌন্দর্য চোখে পড়ে চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমি এলাকায়। সামান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেক আগে থেকে এটি চট্টগ্রামের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানে গাড়ি রাখার কোনো জায়গা নেই, নেই কোনো ফুটপাত। ফলে গাড়ি রাখা, বসে খাওয়া, ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্ট সবই সড়কের উপর। তবে সেখানে অনন্য সৌন্দর্য হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর পাশ দিয়ে বড় জাহাজ চলাচল অবলোকন।
শহুরে কোলাহল থেকে একটু দূরে আরেকটি জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের টোল সড়ক। এই সড়ক ঘিরে দুপাশে গড়ে ওঠেছে প্রচুর পিকনিককেন্দ্র। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ সেখানে যান। কিন্তু একজন বিদেশি পর্যটকের এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ নেই। কারণ সেখানে থাকা খাওয়া এবং বিনোদনের সুযোগ নেই।
সাগরপাড়ের অপরূপ সেই সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে একটি ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু সেখানে জাহাজ ভিড়ার জন্য নতুন বে-টার্মিনালের কারণে সেই উদ্যোগ থমকে যায়।
তবে বে-টার্মিনাল চালু হলে সেখানে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়বে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সবচেয়ে কাছের দূরত্বে হওয়ায় ওই স্থানে গড়ে ওঠতে পারে পাঁচতারা হোটেল। আর তাহলে একজন বিদেশি বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সাগরপাড়ের হোটেলে থাকতে পারবেন। চাইলে কর্ণফুলী টানেল দিয়ে পার হয়ে
আনোয়ারা-বাঁশখালীর উপকূল দেখতে দেখতে চকরিয়ার চিংড়ি প্রজেক্ট ও লবণমাঠে যাবেন। সেখান থেকে ঈদগাঁওয়ের চৌফলদণ্ডী থেকে খুরুসকুল পার হয়ে কক্সবাজার কলাতলী পৌঁছবেন। এরপর চাইলে হিমছড়ি ইনানী হয়ে উখিয়া টেকনাফ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন। একজন পর্যটকের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারে দেশের দীর্ঘতম ‘মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ প্রকল্প।
গাড়ি ব্যবসায়ী মাহবুবুল হক বাবর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে একজন পর্যটক গাড়ি নিয়ে সাগর দেখতে দেখতে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ পৌঁছবেন এটা ভাবতেই তো অন্যরকম ভালো লাগছে। সড়কটি নির্মিত হলে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের পর্যটনে বৈচিত্র্য আসবে, পাবে নতুন মাত্রা।’
জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে সমুদ্র তীর ঘেঁষে পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল দিয়ে আনোয়ারা-বাঁশখালী এবং সেখান থেকে চকরিয়া ও খুরুসকুল হয়ে কক্সবাজার কলাতলী হয়ে টেকনাফের সাবরাংয়ের বিশেষ পর্যটন অঞ্চল পর্যন্ত একটি ‘মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়কটি নির্মাণে সড়ক মন্ত্রণালয় থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে পৌনে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি ২৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী ১৪ অক্টোবর চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে সফরে এই সড়কের জন্য অর্থায়ন চাওয়া হবে। দেশটি রাজি হলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সুত্র: কালেরকন্ঠ