বিশ্বসেরা হয়ে ওঠার গল্প: লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি—এক নামেই তাকে চেনেন গোটা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমী জনতা। আমেরিকান ফুটবল ক্লাব ইন্টার মায়ামির ফরোয়ার্ড, আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের বিশ্বকাপজয়ী ক্যাপ্টেন, দীর্ঘ ৩৬ বছর পরে যিনি আর্জেন্টিনাকে এনে দিয়েছেন তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। ৮ বারের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী, লা লিগার এক সিজনের এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা—অনেক অর্জন তার। মেসি কোন ক্লাবে খেলে এখন, লিওনেল মেসি-এর গেম সম্বন্ধে বিস্তারিত অনেক কিছু জেনে নিতে পারবেন আমাদের এই লেখা থেকে।
বিস্ময়বালক লিও
লিওনেল মেসি জন্মগ্রহণ করেন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে, ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মেসির বাবা কাজ করতেন একটি স্টিল কারখানায়, মা ছিলেন একজন দোকান সহকারী। একেবারেই বাচ্চা বয়সে মেসি ফুটবল খেলা শুরু করেন। ফুটবলে প্রতিভা দেখে তার দাদি তাকে অনুপ্রেরণা দেন ভালো একটি ক্লাবে যোগ দিতে। মেসির ট্রেডমার্ক দুইহাতের অনামিকা তুলে গোল উদযাপনের যে ভঙ্গি, তা তার দাদা-দাদির স্মরণেই করেন তিনি।
১৯৯৫ সালে নিজ শহর রোজারিওর শীর্ষ ক্লাব নেওয়েল ওল্ড বয়েজ যুব দলে যোগ দেন মেসি। মেসির বাঁ-পায়ের অসাধারণ দক্ষতা আটলান্টিকের উভয় তীরের নামীদামী ক্লাবগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি ভিডিওটেপ মেসির ভাগ্য বদলে দেয়। ১২-বছর বয়সী মেসির পায়ে বলের কারসাজি ভিডিওতে দেখে স্পেনের বিখ্যাত ক্লাব বার্সেলোনা তাকে ডেকে পাঠায়। তবে সে সময়ে মেসি হরমোন-জনিত একটি সমস্যায় ভুগছিলেন, আর এই সমস্যার জন্য আটকে ছিল তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। হরমোন চিকিৎসার খরচ ছিল অনেক, তবে শিশু মেসির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এই খরচটি দিতে রাজি হয় বার্সেলোনা। ১৩ বছর বয়সে মেসি এবং তার পরিবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরিত হন এবং তিনি খেলা শুরু করেন এফসি বার্সেলোনার লা মাসিয়া যুব দলে। জুনিয়র দলের হয়ে ১৪টি গেমে ২১টি গোল করেন মেসি, এবং মাত্র ১৬ বছর বয়সে একটি প্রীতি ম্যাচে এফসি বার্সেলোনা ক্লাবের হয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় লিওনেল মেসি-এর গেম।
বার্সেলোনার জাদুকর
মেসি কোন ক্লাবে খেলে, তা যেন একসময় সমার্থক হয়ে উঠেছিল কাতালুনিয়ান ক্লাব বার্সেলোনার সাথে। বার্সেলোনার হয়ে মেসির আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় ২০০৪ সালে, তখন মেসি সতের বছর বয়সী এক কিশোর। প্রথম গোলটি আসে তার পরের বছর, প্রতিযোগিতামূলক কোন ম্যাচে বার্সেলোনার হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে করা গোলের রেকর্ডটি নিজের নামে করে নেন মেসি। বল কাটানোর অসাধারণ দক্ষতা, দূরদৃষ্টি আর গোল করার দারুণ ক্ষমতার কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেসি বার্সেলোনা দলের এক জরুরি খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। ২০০৮-০৯ সিজন যখন চলছে, ততদিনে মেসি ফুটবল জগতের একজন তারকা হয়ে উঠেছেন, আর দলের জন্য হয়ে উঠেছেন অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। ৩৮ গোল নিয়ে সিজন শেষ করা মেসি কে সে বছর ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়ের তকমা দেয় উয়েফা। পরের বছর ২০০৯-১০ সিজনে ৪৭ গোল করেন মেসি, আর নিজের প্রথম ব্যালন ডি’অরটা অর্জন করে নেন।
পরবর্তী কয়েক বছরে লিওনেল মেসি-এর গেম অসামান্য এক পর্যায়ে চলে যায়, সাথে বার্সেলোনার স্বর্ণযুগ চলে পেপ গার্দিওলার কোচিংয়ে। ২০১০ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে মেসি একটানা ৪ টি ব্যালন ডি’অর জেতেন, আর ভাঙতে থাকেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। বার্সেলোনা ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডটি তিনি নিজের নামে করে নেন এই সময়ে, একই সাথে এক বছরে সর্বোচ্চ ৯১টি গোল করেন। পেপ গার্দিওলা তার নিজের চমৎকার ক্যারিয়ারের পিছনে মেসির ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, “আমি তার (মেসি) মত আর কাউকেই দেখিনি…আমরা সৌভাগ্যবান যে মেসিকে পেয়েছি।”
২০১৪-১৫ সিজন আসতে আসতে বার্সেলোনার কোচ বদলে গেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু সব ম্যানেজারের জন্যই মেসি ছিলেন আক্রমণভাগের প্রধান শক্তি। এই সিজনে লুই এনরিকের দেখানো পথে বার্সেলোনা ট্রেবল জয় করে, সুয়ারেজ এবং নেইমারের সাথে মিলে ইউরোপের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আক্রমণের শিরোমণি হয়ে ওঠেন লিওনেল মেসি। মুগ্ধ লুই এনরিকে পরবর্তীতে লিওনেল মেসি-এর গেম নিয়ে মন্তব্য করেছেন, “মেসি একজন জিনিয়াস। সে হারতে পছন্দ করে না, এক প্রতিযোগিতার মেশিন হচ্ছে মেসি।”
বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন লিওনেল মেসি। ১০টি লা লিগা শিরোপা, ৭টি কোপা ডেল রে ট্রফি, আর ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ তিনি জয় করেছেন এ ক্লাবের হয়ে। ৬০০ এর বেশি গোল নিয়ে মেসি ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার সর্বোচ্চ গোলদাতা। যদিও মেসির চেষ্টার কোন ক্রুটি ছিল না, কিন্তু ২০১৫ এর পরে বার্সেলোনা আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতেনি। ২০২১ এর গ্রীষ্মে বার্সেলোনাতে মেসির টানা ২১ বছরের যাত্রা শেষ হয়। ফ্রি ট্র্যান্সফারে মেসি চলে যান প্যারিস সেইন্ট জারমাইতে।
বিশ্বকাপ জয়
বিশ্বের সেরা ফুটবলারের তকমা লিওনেল মেসি যতবার জয় করেছেন, তার ধারে-কাছেও পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো ফুটবলার যেতে পারবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফিটাই ছিল তার অধরা। এই একটি ট্রফি ছাড়া যদি মেসি ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করতেন, তাহলে ফুটবলই যেন ব্যর্থ হয়ে যেতো। সেই ব্যর্থতার দায় বহন করতে হয়নি ফুটবলকে। ২০২২ এর ১৮ ডিসেম্বর কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা, ফাইনাল ম্যাচে বল দুইবার জালে ঢুকিয়ে রাত শেষে বিজয়ীর ট্রফি তুলে ধরেন লিওনেল মেসি।
রেকর্ডভাঙা মেসি
ফুটবল বিশ্বের বিভিন্ন রেকর্ড ভাঙাটাই যেন লিওনেল মেসি-এর গেম। চলুন, আর্জেন্টাইন এই বিশ্বসেরা ফুটবলারের কয়েকটি রেকর্ড দেখে নিই:
- লা লিগার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনেল মেসি। বার্সেলোনার হয়ে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ৪৭৪টি গোল করেছেন। লা লিগায় সবচেয়ে বেশিবার হ্যাট্রিক করার কৃতিত্বও তার, মোট হ্যাট্রিকের সংখ্যা ৩৬।
- রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন মেসি, ২৬টি।
- ৩৭৯টি অ্যাসিস্ট নিয়ে বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অ্যাসিস্টের কৃতিত্বও লিওনেল মেসির।
- আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গোল করেছেন মেসি, ১৯১ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১১২টি গোল।
- মেসির ব্যালন ডি’অরের সংখ্যা ৮টি, পৃথিবীর অন্য কোন ফুটবলার এর ধারেকাছেও ব্যালন ডি’অর পাননি। তার সর্বমোট ট্রফি সংখ্যা ৪৫, যা আর কোন ফুটবলারের নেই।
পরিসংখ্যানের বাইরে মেসির পায়ের জাদুতে শ্রেফ মুগ্ধ নন, এমন ফুটবলপ্রেমী সারা দুনিয়াতে বিরল। ৩৭ বছর বয়সী লিওনেল মেসি দাপট নিয়ে খেলছেন এখনও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টার মায়ামি ক্লাবে, শুধু তার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলের জনপ্রিয়তা এখন বাড়ছে।
মেসির সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স কিংবা তার দল ইন্টার মায়ামি কেমন খেলছে – তা নিয়ে দুনিয়াজোড়া ফুটবলপ্রেমীদের জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি ইন্টার মিয়ামি ম্যাচে মেসি গোল করবেন কি না, করলে কয়টি গোল করবেন, মেসির দল জিতবে কি না – পূর্বাভাস আসছে এসব সম্ভাবনার। আপনিও সহজেই ভবিষ্যতবাণীর এ গেমে অংশ নিতে পারেন বিকাশ দিয়ে বাজি ধরে। আজই ভিজিট করুন MightyTips ওয়েবসাইটে, নিবন্ধগুলি পড়ে জেনে নিন কোন বুকমেকারের রিভিউ কেমন, কোন ওয়েবসাইটগুলো বাজির জন্য সেরা এবং ঝুঁকিমুক্তভাবে কীভাবে খেলতে হয়।
পেলে বা মারাদোনার সাথে মেসিকেও সর্বকালের সেরাদের কাতারে রাখা হয় অনেকবছর ধরেই। এ সম্বন্ধে মেসি কে জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজের বিনয়ী ব্যক্তিত্বের পরিচয়টাই দিয়েছেন উত্তরে, “আমি কখনোই নিজেকে সেরা ভাবিনা, আমি তো আরেকজন খেলোয়াড়ই কেবল।” দুনিয়াজোড়া মেসি ভক্তরা অবশ্য এই কথা মানতে নারাজ, তাদের কথা স্পষ্ট, সর্বকালের সেরা ফুটবলার হচ্ছেন লিওনেল মেসি।
পাঠকের মতামত