বিগত কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশ–মিয়ানমারের সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মর্টার এবং বোমা হামলা চালিয়েছে। জান্তা সরকারের শাসনাধীন মিয়ানমারের এমন আচরণ কেবল বাংলাদেশ সীমান্তেই নয়। দেশটির অভ্যন্তরের পরিস্থিতিও বেশ উত্তপ্ত। জান্তা সরকার নিয়মিতই সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে বিরোধীদের। এসব প্রতিরোধে হতাহতের সংখ্যাও কম নয়।
গত ২৮ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপিত দুটি মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর উত্তর মসজিদের কাছে ভূপতিত হয়। এই ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি। সেই ঘটনার পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই ঘটনার পর ১ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, এই বিষয়ে ভবিষ্যতে মিয়ানমার আরও সতর্ক থাকবে।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের মাত্র দুই দিন পরই আবারও বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের ৪০ পিলার এলাকাজুড়ে বিদ্রোহীদের আস্তানা লক্ষ্য করে দুটি হেলিকপ্টার ও একটি জেট বিমান থেকে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনারা। সীমান্তের ১৩ কিলোমিটার এলাকায় গোলাবর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের জান্তা সরকার মোটেও বাংলাদেশের আপত্তিকে গ্রাহ্য করেনি। বিশ্লেষকদের ধারণা, এই ঘটনা বাংলাদেশ–মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও শীতল করে তুলবে এবং রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কঠিন করে তুলবে।
বাংলাদেশের স্বার্থের জায়গা থেকে সীমান্তে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এই উদ্বেগের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায় যখন বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন আরাকান রাজ্যে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং রাজ্যের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পায়। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার সহিংসতাই বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ–হামলা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।
বিগত কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইরাবতী নিউজসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে—বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনী নিয়মিতই নাস্তানাবুদ হচ্ছে। ইরাবতীর দেওয়া তথ্য অনুসারে, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির হাতে মিয়ানমারের আর্মড পুলিশের ১৯ সদস্য নিহত হয় গত সপ্তাহে। ২ সেপ্টেম্বর সিন রাজ্যে বিদ্রোহীদের হাতে মারা যায় জান্তা বাহিনীর ৬০ সৈন্য। এরও আগে, ১ সেপ্টেম্বর সাগাইন রাজ্যে বিদ্রোহীদের হাতে জান্তা বাহিনীর এক কর্নেলসহ অন্তত ৩৪ জন সদস্য মারা যায়। ৩০ আগস্ট ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ৪৮ ঘণ্টায় বিদ্রোহীদের হাতে মারা যায় অন্তত ৩০ জান্তা সৈন্য।
ইরাবতীর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত বিগত ১৫ মাসে কেবল কায়াহ রাজ্যেই কারেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘাতে ১ হাজার ৪৯৯ সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। বিপরীতে বিদ্রোহী যোদ্ধা মারা গেছে ১৫১ জন। এই সময়ে রাজ্যটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ২ লাখ মানুষ। দেশটির অন্যান্য রাজ্যের অবস্থাও কম–বেশি একই রকম। জান্তা বাহিনীর এমন কোণঠাসা অবস্থা তাদের আরও সহিংস করে তুলবে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
দেশটি কেবল সশস্ত্র সংঘাতই বাড়েনি, রাজনৈতিকভাবেও দেশটিতে অস্থিরতা বেড়েছে। ২০২১ সালের শুরুর দিকে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সুচির দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনক্ষমতা দখল করে জান্তা। এরপর থেকেই বিরোধী মত দমন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ সুচিকে আরও তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে জান্তা নিয়ন্ত্রিত আদালত। একই দিনে দেশটিতে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ও তাঁর স্বামীকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। তারও আগে, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী গণহত্যার চালিয়েছে—এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।
সব মিলিয়ে মিয়ানমারে জান্তা সরকার যতই তাদের দমন–পীড়নের মাত্রা বাড়াচ্ছে বিদ্রোহীদের হাতে সেনা মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরও জান্তা বাহিনীর পিছু হটার কোনো লক্ষণ নেই। জান্তা বাহিনীর এমন মনোভাব দেশটির অভ্যন্তর তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অস্থিতশীলতা তৈরির পরিস্থিতি তৈরি করছে। মার্কিন থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের এক নিবন্ধে এমন আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনীকে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে ওই নিবন্ধে।
তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা, দ্য গার্ডিয়ান, উইলসন সেন্টার, বিবিসি, ইরাবতী নিউজ
পাঠকের মতামত